পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষড়্‌বিংশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৪১১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

বাংলাভাষা-পরিচয় । ליפס নাম দেওয়া হয়েছে সাধু ভাষা ; আর-একটাকে কথ্য ভাষা, কেউ বলে চলতি ভাষা, আমার কোনো কোনো লেখায় আমি বলেছি প্রাকৃত বাংলা । সাধু ভাষা মাজাঘব, ংস্কৃত ব্যাকরণ অভিধান থেকে ধার করা অলংকারে সাজিয়ে তোলা। চলতি ভাষার আটপৌরে সাজ নিজের চরকায় কাটা স্বতে দিয়ে বোনা। অলংকারের কথা যদি জিজ্ঞাসা কর কালিদাসের একটা লাইন তুলে দিলে তার জবাব হবে ; কবি বলেন : কিমিব হি মধুরাণাং মণ্ডলং নাকৃতীনাম্। যার মাধুর্ব আছে সে যা পরে তাতেই তার শোভা ৷ রূপকথায় শুনেছি স্বয়োরানী ঠাই দেয় দুয়োরানীকে গোয়ালঘরে। কিন্তু গল্পের পরিণামের দিকে দেখি সুয়োরানী বায় নির্বাসনে, টিকে থাকে একলা দুয়োরানী রানীর পদে । বাংলায় চলতি ভাষা বহু কাল ধরে জায়গা পেয়েছে সাধারণ মাটির ঘরে, হেশেলের সঙ্গে, গোয়ালের ধারে, গোবর-নিকোনো আঙিনার পাশে যেখানে সন্ধেবেলায় প্রদীপ জালানো হয় তুলসীতলায় আর বেষ্টনী এসে নাম শুনিয়ে যায় ভোরবেলাতে। গল্পের শেষ অংশটা এখনো সম্পূর্ণ আসে নি, কিন্তু আমার বিশ্বাস স্বয়োরানী নেবেন বিদায় আর একলা দুয়োরানী বলবেন রাজাসনে । চলতি ভাষার চলার বিরাম নেই, তার চলবার শক্তি আড়ষ্ট হবার সময় পায় না । আমাদের মুখরিত দিনরাত্রির সব কথা করে পড়ছে তার মাটিতে, তার সঙ্গে মিশিয়ে গিয়ে তার প্রকাশের শক্তিকে করছে উর্বরা । তবু একটা কথা মানতে হবে যে, মাহুষের বলবার কথা সবই যে সহজ তা নয় ; এমন কথা আছে যা ভালো করে এঁটে না বললে বলাই হয় না। সেই-সব বিচার-করা কথা কিংবা সাজিয়ে-বলা কথা চলে না দিনরাত্রির ব্যবহারে, যেমন চলে না দরবারি পোশাক কিংবা বেনারলি শাড়ি । আমরা সর্বদা মুখের কথায় বিজ্ঞান আওড়াই নে। তত্ত্বকথাও পণ্ডিতলভার, তার আলোচনায় বিশেষ বিস্তার দরকার করে । তাই তর্ক ওঠে, এদের জন্তে চলতি ভাষার বাইরে একটা পাকা গাখুনির ভাষা বানানো নেহাত দরকার ; সাধু ভাষায় এরকম মহলের পত্তন সহজ, কেননা, ও ভাষাটাই বানানো। কথাটা একটু বিচার করে দেখা যাক। আমরা লিখিয়ে-পড়িয়ের দলে চলতি ভাষাকে অনেক কাল থেকে জাতে ঠেলেছি। সাহিত্যের আসরে তাকে পা বাড়াতে দেখলেই জরোয়ান এসেছে তাড়া করে। সেইজন্তেই খিড়কির দরজায় পথ চলার অভ্যাসটাই ওর হয়ে গেছে স্বাভাবিক । অম্বরমহলে যে মেয়েরা অভ্যস্ত তাদের ব্যবহার সহজ হয় পরিচিত আত্মীয়দের মধ্যেই, বাইরের লোকদের সামনে তাদের মুখ দিয়ে কথা সরে না । তার কারণ এ নয় যে তাদের শক্তি নেই, কিন্তু সংকুচিত হয়েছে তাদের শক্তি। পাশ্চাত্য জাতিদের ভাষায় এই সদর-অঙ্গরের বিচার নেই। তাই