পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষড়্‌বিংশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৪২১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

বাংলাভাষা-পরিচয় ჭoტ ছিল না তার নিজের হাতে ; যখন তার আকাশ থাকত শাস্ত তখন গ্রামের এ ঘাটে ও ঘাটে চলত তার আনাগোনা সামান্ত কারবার নিয়ে, কখনো বা দিনের পর দিন দুৰ্যোগ লেগেই থাকত, ভাগ্যের অনিশ্চয়তায় হঠাৎ কে কোথায় পৌছয় তার ঠিক ছিল না, হঠাৎ নৌকোস্বদ্ধ হত ভরাডুবি । এরা ছড়া বাধে নি নিজের কোনো স্মরণীয় ইতিহাস নিয়ে । এরা গান বাধে নি ব্যক্তিগত জীবনের স্বখদুঃখবেদনায় । এরা নিঃসন্দেহই ভালোবেলেছে, কিন্তু নিজের জবানিতে প্রকাশ করে নি তার হাসিকান্না। দেবতার চরিত-বৃত্তাস্তে এরা ঢেলেছে এদের অস্তরের আবেগ ; হরপার্বতীর লীলায় এরা নিজের গৃহস্থালির রূপ ফুটিয়েছে, রাধাকৃষ্ণের প্রেমের গানে এরা সেই প্রেমের কল্পনাকে মনের মধ্যে ঢেউ লাগিয়েছে যে প্রেম সমাজবন্ধনে বন্দী নয়, যে প্রেম শ্ৰেয়োবুদ্ধি-বিচারের বাইরে। একমাত্র কাহিনী ছিল রামায়ণ-মহাভারতকে অবলম্বন করে যা মানবচরিত্রের নতোরতকে নিয়ে হিমালয়ের মতো ছিল দিক থেকে দিগন্তরে প্রসারিত। কিন্তু সে হিমালয় বাংলাদেশের উত্তরতম সীমার দূর গিরিমালার মতোই ; তার অভ্ৰভেদী মহত্বের কঠিন মূর্তি সমতল বাংলার রসাতিশয্যের সঙ্গে মেলে না। তা বিশেষভাবে বাংলার নয়, তা সনাতন ভারতের । অন্নদামঙ্গলের সঙ্গে, কবিকঙ্কণের সঙ্গে, রামায়ণ-মহাভারতের তুলনা করলে উভয়ের পার্থক্য বোঝা যাবে। অন্নদামঙ্গল চণ্ডীমঙ্গল বাংলার ; তাতে মহন্তত্বের বীর্ঘ প্রকাশ পায় নি, প্রকাশ পেয়েছে অকিঞ্চিৎকর প্রাত্যহিকতার অন্ধুজল জীবনযাত্র । এই কাব্যের পণ্য ভেসেছিল পয়ার ছন্দে । ভাঙাচোরা ছিল এর পদবিন্যাস । গানের স্বর দিয়ে এর অসমানতা মিলিয়ে দেওয়া হত, দরকার হত না অক্ষর সাজাবার কাজে সতর্ক হবার । পুরানো কাব্যের পুথি দেখলেই তা টের পাওয়া যায়। অত্যন্ত উচুনিচু তার পথ। ভারতচন্দ্রই প্রথম ছন্দকে সৌষম্যের নিয়মে বেঁধেছিলেন। তিনি ছিলেন সংস্কৃত ও পারসিক ভাষায় পণ্ডিত । ভাষাবিন্যাসে ছন্দে প্রাদেশিকতার শৈথিল্য তিনি মানতে পারেন নি । পয়ার ছন্দের একেশ্বরত্ব ছাড়িয়ে গিয়ে বিচিত্র হয়েছে ছন্দ বৈষ্ণব পদাবলীতে । তার একটা কারণ, এগুলি একটানা গল্প নয়। এই পদগুলিতে বিচিত্র হৃদয়াবেগের সংঘাত লেগেছে । দোলায়িত হয়েছে লেই আবেগ তিনমাত্রার ছন্মে। দ্বৈমাত্রিক এবং ত্রৈমাত্রিক ছন্দে বাংলা কাব্যের আরম্ভ। এখনো পর্যন্ত ঐ দুই জাতের মাত্রাকে নানা প্রকারে সাজিয়ে বাংলায় ছন্দের লীলা চলছে । আর আছে দুই এবং তিনের জোড় বিজোড় সংখ্যা মিলিয়ে পাচ কিংবা নয়ের অসম মাত্রার ছন্দ । মোট কথা বলা যায়, দুই এবং তিন সংখ্যাই বাংলার সকল ছন্দের মূলে। তার