পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষড়্‌বিংশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৪৯৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8ԳԾ) রবীন্দ্র-রচনাবলী আসল কথা, সমুদ্র বোম্বাই শহরকে আকার দিয়াছে, নিজের অর্ধচন্দ্রাকৃতি বেলাভূমি দিয়া তাহাকে অঁাকড়িয়া ধরিয়াছে। সমূত্রের আকর্ষণ বোম্বাইয়ের সমস্ত রাস্তা-গলির ভিতর দিয়া কাজ করিতেছে । আমার মনে হইতেছে, যেন সমুদ্রটা একটা প্রকাও হৃৎপিণ্ড, প্রাণধারাকে বোম্বাইয়ের শিরা-উপশিরার ভিতর দিয়া টানিয়া লইতেছে এবং ভরিয়া দিতেছে। সমূদ্র চিরদিন এই শহরটিকে বৃহৎ বাহিরের দিকে মুখ করিয়া । রাখিয়া দিয়াছে। * প্রকৃতির সঙ্গে কলিকাতার মিলনের একটি বন্ধন ছিল গঙ্গা । এই গঙ্গার ধারাই স্বরের বার্তাকে স্থদুর রহস্তের অভিমুখে বহিয়া লইয়া যাইবার খোলা পথ ছিল। শহরের এই একটি জানালা ছিল যেখানে মুখ বাড়াইলে বোঝা যাইত, জগংটা এই লোকালয়ের মধ্যেই বদ্ধ নহে । কিন্তু, গঙ্গার প্রাকৃতিক মহিমা আর রহিল না, তাহাকে দুই তীরে এমনি আঁটাসাটা পোশাক পরাইয়াছে, এবং তাহার কোমরবন্ধ এমন কষিয়া বাধিয়াছে যে, গঙ্গাও লোকালয়েরই পেয়াদার মূতি ধরিয়াছে, গাধাবোট বোঝাই করিয়া পাটের বস্তা চালান করা ছাড়া তাহার যে আর-কোনো বড়ো কাজ ছিল তাহা আর বুঝিবার জো নাই। জাহাজের মাস্তলের কণ্টকারণ্যে মকরবাহিনীর মকরের শুড় কোথায় লজ্জায় লুকাইল । সমুত্রের বিশেষ মহিমা এই যে, মানুষের কাজ সে করিয়া দেয় কিন্তু দাসত্বের চিহ্ন সে গলায় পরে না। পাটের কারবার তাহার বিশাল বক্ষের নীলকান্ত মণিটিকে ঢাকিয়া ফেলিতে পারে না। তাই এই শহরের ধারে সমুদ্রের মূতিটি অক্লান্ত ; যেমন এক দিকে সে মানুষের কাজকে পৃথিবীময় ছড়াইয়া দিতেছে তেমনি আর-এক দিকে সে মানুষের শ্রান্তি হরণ করিতেছে, ঘোরতর কর্মের সম্মুখেই বিরাট একটি অবকাশকে মেলিয়া রাখিয়াছে। তাই আমার ভারি ভালো লাগিল যখন দেখিলাম, শত শত নরনারী সাজসজা করিয়া সমূত্রের ধারে গিয়া বলিয়াছে। অপরান্ধের অবসরের সময় সমূত্রের ডাক কেছ অনান্ত করিতে পারে নাই। সমূত্রের কোলের কাছে ইহাদের কাজ, এবং সমৃত্রের কোলের কাছে ইহাদের আনন্দ । আমাদের কলিকাতার শহরে এক ইডেন-গার্ডেন আছে, কিন্তু লে রূপণের ঘরের মেয়ে, তাহার কণ্ঠে জাহান নাই। সেই রাজপুরুষের তৈরি বাগান— সেখানে কত শাসন, কত নিষেধ। কিন্তু, সমূদ্র তো কাহারও তৈরি নহে, ইহাকে তো বেড়িয়া রাখিবার জো নাই। এইজন্ত সমূত্রের ধারে বোম্বাই শহরের এমন নিত্যোৎসব। কলিকাতার কোথাও তো সেই অসংকোচ আনন্দের একটুকু স্থান নাই।