পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষড়্‌বিংশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৫৯৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

রবীন্দ্র-রচনাবলী . به আজ রবিবার। গির্জার ঘণ্টা বাজিতেছে। সকালে চোখ মেলিয়াই দেখিলাম, বরফে সমস্ত সাদা হইয়া গিয়াছে। বাড়িগুলির কালে রঙের ঢালু ছাদ এই বিশ্বব্যাপী সাদার আবির্ভাবকে বুক পাতিয়া দিয়া বলিতেছে, ‘আধো আঁচরে বোলো!" মাহুষের চলাচলের রাস্তায় ধুলাকাদার রাজত্ব একেবারে ঘুচাইয়া দিয়া শুভ্রতার নিশ্চল ধারা যেন শতধা হইয়া বহিয়া চলিয়াছে। গাছে একটিও পাতা নাই ; শুক্রম শুদ্ধমপাপবিদ্ধম্। ডালগুলির উপরের চূড়ায় তাহার আশীৰ্বাদ বর্ষণ করিয়াছেন । রাস্তার দুই ধারের ঘাস যৌবনের শেষ চিহ্নের মতো এখনো সম্পূর্ণ আচ্ছন্ন হয় নাই, কিন্তু তাহারা ধীরে ধীরে মাথা হেঁট করিয়া হার মানিতেছে। পাখিরা ডাক বন্ধ করিয়াছে, আকাশে কোথাও কোনো শব্দ নাই। বরফ উড়িয়া উড়িয়া পড়িতেছে, কিন্তু তাহার পদসঞ্চার কিছুমাত্র শোনা যায় না— বর্ষ আসে বৃষ্টির শব্দে, ডালপালার মর্মরে, দিগদিগন্ত মুখরিত করিয়া দিয়া রাজবদুন্নতধ্বনিঃ– কিন্তু আমরা সকলেই যখন ঘুমাইতেছিলাম আকাশের তোরণদ্বার তখন নীরবে খুলিয়াছে, সংবাদ লইয়া কোনো দূত আসে নাই, সে কাহারও ঘুম ভাঙাইয়া দিল না। স্বৰ্গলোকের নিভৃত আশ্রম হইতে নি:শব্দত মর্তে নামিয়া আসিতেছেন ; তাহার ঘর্ঘরনিনাদিত রথ নাই ; মাতলি তাহার মত্ত ঘোড়াকে বিদ্যুতের কষাঘাতে হাকাইয়া আনিতেছে না ; ইনি নামিতেছেন ইহার সাদা পাখা মেলিয়া দিয়া, অতি কোমল তাহার সঞ্চার, অতি অবাধ তাহার গতি ; কোথাও তাহার সংঘর্ষ নাই, কিছুকেই সে কিছুমাত্র আঘাত করে না। স্থৰ আবৃত, আলোকের প্রখরতা নাই ; কিন্তু, সমস্ত পৃথিবী হইতে একটি অপ্ৰগলভ দীপ্তি উদ্ভাসিত হইয়া উঠিতেছে, এই জ্যোতি যেন শাস্তি এবং নম্রতায় স্থলম্বৃত, ইহার অবগুণ্ঠনই ইহার প্রকাশ । স্তন্ধ শীতের প্রভাতে এই অপরূপ শুভ্রতার নির্মল আবির্ভাবকে আমি নত হইয়া নমস্কার করি— ইহাকে আমার অন্তরের মধ্যে বরণ করিয়া লই। বলি, ‘তুমি এমনি ধীরে ধীরে ছাইয়া ফেলো ; আমার সমস্ত চিন্তা, সমস্ত কল্পনা, সমস্ত কর্ম আবৃত করিয়া দাও । গভীর রাত্রির অসীম অন্ধকার পার হইয়া তোমার নির্মলতা আমার জীবনে নিশৰে অবতীর্ণ হউক, আমার নবপ্রভাতকে অকলঙ্ক শুভ্রতার মধ্যে উজবোধিত করিয়া তুলুক— বিশ্বানি দুরিতানি পরাস্বৰ— কোথাও কোনো কালিনা কিছুই রাখিয়ে না, তোমার স্বর্গের আলোক যেমন নিরবচ্ছিন্ন শুভ্র আমার জীবনের ধরাতলকে তেমনি একটি অধও শুভ্রতায় একবার সম্পূর্ণ সমাবৃত করিয়া দাও।