পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/১৯৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গোরা Sb-A ধারেন না । হোটেলে খানা খাইয়া বাহাদুরি করাকেও তিনি বাড়াবাড়ি মনে করেন আবার গোরার মতো সর্বদা শ্রতিস্থতি লইয়া ঘাটাঘাটি করাকেও তিনি প্রকৃতিস্থ লোকের লক্ষণ বলিয়া জ্ঞান করেন না। কিন্তু, যস্মিন দেশে যদাচার;— গোরার কাছে শাস্ত্রের দোহাই পাড়িতে হইল । এ প্রস্তাব যদি দুইদিন আগে আসিত তবে গোরা একেবারে কানেই লক্টত না । আজ তাহার মনে হইল, কথাটা নিতাস্ত উপেক্ষার যোগ্য নহে । অস্তত এই প্রস্তাবটা লষ্টয়া এখনই বিনয়ের বাসায় যাইবার একটা উপলক্ষ্য জুটিল । গোর শেষকালে বলিল, “আচ্ছা, বিনয়ের ভাবখানা কী বুঝে দেখি ” মহিম কছিলেন, “সে আর বুঝতে হবে না। তোমার কথা সে কিছুতেই ঠেলতে পারবে না । ও ঠিক হয়ে গেছে । তুমি বললেই হবে ।” সেই সন্ধ্যার সময়েই গোর বিনয়ের বাসায় আসিয়া উপস্থিত । ঝড়ের মতো তাহার ঘরে প্রবেশ করিয়া দেখিল ঘরে কেহ নাই । বেহারীকে ডাকিয়া জিজ্ঞাসা করাতে সে কছিল, “বাৰু আটান্তর নম্বর বাড়িতে গিয়াছেন " শুনিয়া গোরার সমস্ত মন বিকল হইয়া উঠিল। আজ সমস্ত দিন যাহার জন্য গেরিার মনে শাস্তি ছিল না সেই বিনয় আজকাল গোরার কথা মনে করিবার অবকাশমাত্র পায় না । গোরা রাগই করুক আর দু:খিতষ্ট হউক, বিনয়ের শাস্তি ও সাস্তুনার কোনো ব্যাঘাত ঘটিবে না । পরেশবাবুর পরিবারদের বিরুদ্ধে, ব্রাহ্মসমাজের বিরুদ্ধে, গোরার অন্ত:করণ একেবারে বিষাক্ত হইয়া উঠিল। সে মনের মধ্যে প্রকাণ্ড একটা বিদ্রোহ বহন করিয়া পরেশবাবুর বাড়ির দিকে ছুটিল । ইচ্ছা ছিল সেখানে এমন-সকল কথা উত্থাপন করিবে যাহা শুনিয়া এই ব্রাহ্ম পরিবারের হাড়ে জালা ধরিবে এবং বিনয়েরও আরাম বোধ হইবে না। পরেশবাবুর বাসায় গিয়া শুনিল তাহারা কেহই বাড়িতে নাই, সকলেই উপাসনামন্দিরে গিয়াছেন। মুহূর্তকালের জন্য সংশয় হইল বিনয় হয়তো যায় নাই—লে হয়তো এই ক্ষণেই গোরার বাড়িতে গেছে । থাকিতে পারিল না । গোরা তাহার স্বাভাবিক ঝড়ের গতিতে মন্দিরের দিকেই গেল । দ্বারের কাছে গিয়া দেখিল বিনয় বরদাসুন্দরীর অমুসরণ করিয়া তাহাদের গাড়িতে উঠিতেছে— সমস্ত রাস্তার মাঝখানে নিলজের মতো অন্য পরিবারের মেয়েদের সঙ্গে এক গাড়িতে গিয়া বসিতেছে! মূঢ় ! নাগপাশে এমনি করিয়াই ধরা দিতে হয় ! এত সত্বর ! এত সহজে ! তবে বন্ধুত্বের আর ভদ্রস্থতা নাই । গোরা ঝড়ের মতোই ছুটিয়া চলিয়া গেল— আর গাড়ির অন্ধকারের মধ্যে বিনয় রাস্তার দিকে তাকাইয়া চুপ করিয়া বসিয়া রহিল।