পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/২০৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গোরা వ9 কিন্তু এ কী পাগলামি ! এ কী অস্তায় । হোক অন্যায়, আর তো ঠেকাইয়া রাখা যায় না। এই স্রোতেই যদি কোনো একটা কুলে তুলিয়া দেয় তো ভালো, আর যদি ভাসাইরা দেয়, যদি তলাইয়া লয় তবে উপায় কী ! মুশকিল এই যে, উদ্ধারের ইচ্ছাও হয় না— এতদিনকার সমস্ত সংস্কার, সমস্ত স্থিতি হারাইয়া চলিয়া যাওয়াই যেন জীবনের সার্থক পরিণাম । গোরা চুপ করিয়া শুনিতে লাগিল । এই ছাতে এমনি নির্জন নিযুপ্ত জ্যোৎস্বারাত্রে আরও অনেক দিন দুই জনে অনেক কথা হইয়া গেছে— কত সাহিত্য, কত লোকচরিত্র, কত সমাজহিতের আলোচনা, ভবিষ্যৎ জীবনযাত্রা সম্বন্ধে দুই জনের কত সংকল্প । কিন্তু এমন কথা ইহার পূর্বে আর কোনো দিন হয় নাই । মানবহৃদয়ের এমন একটা সত্য পদার্থ, এমন একটা প্রবল প্রকাশ এমন করিয়া গোরার সামনে আসিয়া পড়ে নাই । এই-সমস্ত ব্যাপারকে সে এতদিন কবিত্বের আবর্জনা বলিয়া সম্পূর্ণ উপেক্ষা করিয়া আসিয়াছে— আজ সে ইহাকে এত কাছে দেখিল যে ইহাকে আর অস্বীকার করিতে পারিল না। শুধু তাহাই নয়, ইহার বেগ তাহার মনকে ঠেলা দিল, ইহার পুলক তাঙ্গার সমস্ত শরীরের মধ্যে বিছাতের মতো খেলিয়া গেল। তাহার যৌবনের একটা অগোচর অংশের পর্দা মুহূর্তের জন্য হাওয়ায় উড়িয়া গেল এবং সেই এতদিনকার রুদ্ধ কক্ষে এই শরৎ-নিশীথের জ্যোৎস্না প্রবেশ করিয়া একটা মায়া বিস্তার করিয়া দিল । চন্দ্র কখন এক সময় ছাদগুলার নীচে নামিয়া গেল । পুর্বদিকে তখন নিদ্রিত মুখের হালির মতো একটুখানি আলোকের আভাস দিয়াছে। এতক্ষণ পরে বিনয়ের মনটা হালকা হইয়া একটা সংকোচ উপস্থিত হইল। একটুখানি চুপ করিয়া থাকিয়া বলিল, “আমার এ-সমস্ত কথা তোমার কাছে খুব ছোটো । তুমি আমাকে হয়তো মনে মনে অবজ্ঞা করছ । কিন্তু কী করব বলো— কখনো তোমার কাছে কিছু লুকোই নি— আজও লুকোলুম না, তুমি বোঝ আর না বোঝ।” গোরা বলিল, “বিনয়, এ-সব কথা আমি যে ঠিক বুঝি তা বলতে পারি নে। দু-দিন আগে তুমিও বুঝতে না । জীবনব্যাপারের মধ্যে এই-সমস্ত আবেগ এবং আবেশ আমার কাছে যে আজ পর্যন্ত অত্যন্ত ছোটো ঠেকেছে সে কথাও অস্বীকার করতে পারি নে। তাই বলে এটা যে বাস্তবিকই ছোটো তা হয়তো নয়— এর শক্তি, এর গভীরতা আমি প্রত্যক্ষ করি নি বলেই এটা আমার কাছে বস্তুহীন মায়ার মতো ঠেকেছে— কিন্তু তোমার এত বড়ো উপলব্ধিকে আজ আমি মিথ্যা বলব কী করে ? আসল কথা হচ্ছে এই, যে লোক যে ক্ষেত্রে আছে সে ক্ষেত্রের বাইরের সত্য যদি তার