পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/২০৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ువు রবীন্দ্র-রচনাবলী প্রভাতের মধ্যেই দেখতে পাচ্ছি— দেখে আমার বুকের ভিতরে কে ডমরু বাজাচ্ছে।” । বলিয়া বিনয়ের হাত লইয়া গোরা নিজের বুকের উপরে চাপিয়া ধরিল। বিনয় কহিল, "ভাই গোরা, আমি তোমার সঙ্গেই যাব । কিন্তু আমি তোমাকে বলছি আমাকে কোনো দিন তুমি দ্বিধা করতে দিয়ে না। একেবারে ভাগ্যের মতে নির্দয় হয়ে আমাকে টেনে নিয়ে যেয়ো । আমাদের দুই জনের এক পথ— কিন্তু আমাদের শক্তি তো সমান নয় ।” গোরা কহিল, “আমাদের প্রকৃতির মধ্যে ভেদ আছে, কিন্তু একটা মহৎ আনন্দে আমাদের ভিন্ন প্রকৃতিকে এক করে দেবে । তোমাতে আমাতে যে ভালোবাসা আছে তার চেয়ে বড়ো প্রেমে আমাদের এক করে দেবে । সেই প্রেম যতক্ষণে সত্য না হবে ততক্ষণে আমাদের দু জনের মধ্যে পদে পদে অনেক আঘাত-সংঘাত বিরোধ-বিচ্ছেদ ঘটতে থাকবে— তার পরে এক দিন আমরা সমস্ত ভুলে গিয়ে, আমাদের পার্থক্যকে আমাদের বন্ধুত্বকেও ভুলে গিয়ে একটা প্রকাও একটা প্রচণ্ড আত্মপরিহারের মধ্যে অটল বলে মিলে গিয়ে দাড়াতে পারব— সেই কঠিন আনন্দই আমাদের বন্ধুত্বের শেষ পরিণাম হবে ।” বিনয় গোরার হাত ধরিয়া কহিল, “তাই হোক ৷” গোরা কছিল, “ততদিন কিন্তু আমি তোমাকে অনেক কষ্ট দেব । আমার সব অত্যাচার তোমাকে সইতে হবে— কেননা আমাদের বন্ধুত্বকেই জীবনের শেষ লক্ষ্য করে দেখতে পারব না— যেমন করে হোক তাকেই বঁচিয়ে চলবার চেষ্টা করে তার অসম্মান করব না । এতে যদি বন্ধুত্ব ভেঙে পড়ে তা হলে উপায় নেই, কিন্তু যদি বেঁচে থাকে তা হলে বন্ধুত্ব সার্থক হবে।” এমন সময়ে দুই জনে পদশব্দে চমকিয়া উঠিয়া পিছনে চাহিয়া দেখিল, আনন্দময়ী ছাতে আসিয়াছেন । তিনি দুই জনের হাত ধরিয়া ঘরের দিকে টানিয়া লইয়া কহিলেন, "চলো শোবে চলো ।” দুই জনেই বলিল, “আর ঘুম হবে না মা ।” “হবে? বলিয়া আনন্দময়ী দুই বন্ধুকে জোর করিয়া বিছানায় পাশাপাশি শোয়াইয়া দিলেন এবং ঘরের দরজা বন্ধ করিয়া দিয়া দু-জনের শিয়রের কাছে পাখা করিতে বসিলেন । বিনয় কছিল, “ম, তুমি পাখা করতে বললে কিন্তু আমাদের ঘুম হবে না।” আনন্দময়ী কহিলেন, “কেমন না হয় দেখব । আমি চলে গেলেই তোমরা আবার কথা আরম্ভ করে দেবে, সেটি হচ্ছে না ।”