পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/২১৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

२०२ রবীন্দ্র-রচনাবলী লজ্জা বোধ করিয়া থাকেন, তথাপি হারানবাবুকে তিনি আদর্শ পুরুষ বলিয়া জ্ঞান করিতেন না । হারানবাবুর সহস্ৰ দোষ তাহার চোখে পড়িত। হারানবাবুর ‘সাম্প্রদায়িক উৎসাহের অত্যাচারে এবং সংকীর্ণ নীরসতায় যদিও স্বচরিতার মন ভিতরে ভিতরে প্রতিদিন তাহার উপর হইতে বিমুখ হইতেছিল, তথাপি হারানবাবুর সঙ্গেই ষে তাহার বিবাহ হইবে এ সম্বন্ধে কোনো পক্ষের মনে কোনো তর্ক বা সন্দেহ ছিল না । ধর্মসামাজিক দোকানে যে ব্যক্তি নিজের উপরে খুব বড়ো অক্ষরে উচ্চ মূল্যের টিকিট মারিয়া রাখে অন্য লোকেও ক্রমে ক্রমে তাহার দুর্মূল্যতা স্বীকার করিয়া লয়। এইজন্য হারানবাবু তাহার মহৎসংকল্পের অনুবর্তী হইয়া যথোচিত পরীক্ষা-দ্বারা স্বচরিত্যকে পছন্দ করিয়া লইলেই যে সকলেই তাহা মাথা পাতিয়া লইবে, এ সম্বন্ধে হারানবাবুর এবং অন্ত কাহারও মনে কোনো দ্বিধা ছিল না । এমন-কি পরেশবাবুও হারানবাবুর দাবি মনে মনে অগ্রাহ করেন নাই । সকলেই হারানবাবুকে ব্রাহ্মসমাজের ভাবী অবলম্বনম্বরূপ জ্ঞান করিত, তিনিও বিরুদ্ধ বিচার না করিয়া তাহাতে সায় দিতেন । এজন্য হারানবাবুর মতো লোকের পক্ষে স্বচরিতা যথেষ্ট হইবে কিনা ইহাই তাহার চিস্তার বিষয় ছিল ; সুচরিতার পক্ষে হারানবাবু কী পর্যন্ত উপাদেয় হইবে তাহা তাহার মনেও হয় নাই । এই বিবাহ প্রস্তাবে কেহই যেমন স্বচরিতার কথাটা ভাবা আবশ্যক বোধ করে নাই, সুচরিতাও তেমনি নিজের কথা ভাবে নাই । ব্রাহ্মসমাজের সকল লোকেরই মতো সেও ধরিয়া লইয়াছিল যে হারানবাবু যেদিন বলিবেন ‘আমি এই কন্যাকে গ্রহণ করিতে প্রস্তুত হইয়াছি সেই দিনই সে এই বিবাহরূপ তাহার মহংকর্তব্য স্বীকার করিয়া লইবে । এই ভাবেই চলিয়া আসিতেছিল । এমন সময় সেদিন গোরাকে উপলক্ষ্য করিয়া হারানবাবুর সঙ্গে স্বচরিতার যে দুই-চারিটি উষ্ণবাক্যের আদানপ্রদান হুইয়া গেল তাহার স্বর শুনিয়াই পরেশের মনে সংশয় উপস্থিত হইল যে, স্বচরিতা হারানবাবুকে হয়তো যথেষ্ট শ্রদ্ধা করে না— হয়তো উভয়ের স্বভাবের মধ্যে মিল না হইবার কারণ আছে । এই জন্যই বরদস্বিন্দরী যখন বিবাহের জন্য তাগিদ দিতেছিলেন তখন পরেশ তাহাতে পূর্বের মতো সায় দিতে পারিলেন না । সেই দিনই বরদাসুন্দরী স্বচরিতাকে নিভৃতে ডাকিয়া লইয়া কহিলেন, “তুমি যে তোমার বাবাকে ভাবিয়ে তুলেছ।” শুনিয়া স্বচরিত চমকিয়া উঠিল— সে যে ভুলিয়াও পরেশবাবুর উদবেগের কারণ হইয়া উঠিবে ইহা অপেক্ষ কষ্টের বিষয় তাহার পক্ষে কিছুই হইতে পারে না । সে মুখ বিবৰ্ণ করিয়া জিজ্ঞাসা করিল, “কেন, আমি কী করেছি ?”