পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/২৮২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

२१० রবীন্দ্র-রচনাবলী পূর্বেও মেলামেশা ও কাজকর্মের মধ্যে স্বচরিতার একটা নির্লিপ্ততা ছিল, এখন সেইটে অত্যন্ত পরিস্ফুট হইয়া উঠিয়াছে। সে যে অভিনয়-কার্যের অভ্যাসে যোগ দিয়াছিল তাহার মধ্যেও তাহার স্বাতন্ত্র্য নষ্ট হয় নাই। কাজের জন্য তাহাকে যতটুকু দরকার সেইটুকু সারিয়াই সে চলিয়া যাইত। স্বচরিতার এইরূপ দূরত্ব প্রথমে বিনয়কে অত্যন্ত আঘাত দিল । বিনয় মিশুক লোক, যাহাদের সঙ্গে তার সৌহৃদ্য তাহাদের নিকট হইতে কোনোপ্রকার বাধা পাইলে বিনয়ের পক্ষে তাহা অত্যন্ত কঠিন হয় । এই পরিবারে স্বচরিতার নিকট হইতেই এতদিন সে বিশেষ ভাবে সমাদর লাভ করিয়৷ আলিয়াছে, এখন হঠাৎ বিন কারণে প্রতিহত হইয়া বড়োই বেদন! পাইল । কিন্তু যখন বুঝিতে পারিল এই একই কারণে স্বচরিতার প্রতি ললিতার মনেও অভিমানের উদয় হইয়াছে তখন বিনয় সাস্তুনালাভ করিল এবং ললিতার সহিত তাহার সম্বন্ধ আরও ঘনিষ্ঠ হইল। তাহার নিকট হইতে সুচরিতাকে এড়াইয়া চলিবার অবকাশও সে দিল না, সে আপনিই স্বচরিতার নিকট-সংস্রব পরিত্যাগ করিল এবং এমনি করিয়া দেখিতে দেখিতে স্বচরিতা বিনয়ের নিকট হইতে বহুদূরে চলিয়া গেল । এবারে কয়দিন গোরা উপস্থিত না থাকাতে বিনয় অত্যস্ত অবাধে পরেশবাবুর পরিবারের সঙ্গে সকল রকম করিয়া মিশিয়া যাইতে পারিয়াছিল । বিনয়ের স্বভাব এইরূপ অবারিতভাবে প্রকাশ পাওয়াতে পরেশবাবুর বাড়ির সকলেই একটা বিশেষ তৃপ্তি অনুভব করিল। বিনয়ও নিজের এইরূপ বাধামুক্ত স্বাভাবিক অবস্থা লাভ করিয়া যেরূপ আনন্দ পাইল এমন আর কখনো পায় নাই । তাহাকে যে ইহাদের সকলেরই ভালো লাগিতেছে ইহাই অনুভব করিয়া তাহার ভালো লাগাইবার শক্তি আরও বাড়িয়া উঠিল । প্রকৃতির এই প্রসারণের সময়ে, নিজেকে স্বতন্ত্র শক্তিতে অনুভব করিবার দিনে, বিনয়ের কাছ হইতে স্বচরিতা দূরে চলিয়া গেল। এই ক্ষতি এই আঘাত অন্ত সময় হইলে দুঃসহ হইত, কিন্তু এখন সেটা সে সহজেই উত্তীর্ণ হইয়া গেল। আশ্চর্য এই যে, ললিতাও স্বচরিতার ভাবান্তর উপলক্ষ করিয়া তাহার প্রতি পূর্বের ন্যায় অভিমান প্রকাশ করে নাই। আবৃত্তি ও অভিনয়ের উৎসাহই কি তাহাকে সম্পূর্ণ অধিকার করিয়াছিল ? এ দিকে স্বচরিতাকে অভিনয়ে যোগ দিতে দেখিয়া হঠাৎ হারানবাবুও উৎসাহিত হইয়া উঠিলেন । তিনি ‘প্যারাডাইস লস্ট হইতে এক অংশ আবৃত্তি করিবেন এবং ড্রাইডেনের কাব্য-আবৃত্তির ভূমিকাস্বরূপে সংগীতের মোহিনী শক্তি সম্বন্ধে একটি ক্ষুদ্র বক্তৃতা করিবেন বলিয়া স্বয়ং প্রস্তাব করিলেন । ইহাতে বরদাসুন্দরী মনে মনে