পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/২৯০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

- রবীন্দ্র-রচনাবলী কেবল একটি ঘর মাত্র হিন্দু নাপিতের সন্ধান পাওয়া গেল। দুই ব্রাহ্মণ তাহারই ঘরে আশ্রয় লইতে গিয়া দেখিল, বৃদ্ধ নাপিত ও তাহার স্ত্রী একটি মুসলমানের ছেলেকে পালন করিতেছে রমাপতি অত্যন্ত নিষ্ঠাবান, সে তো ব্যাকুল হইয়া উঠিল । গোরা নাপিতকে তাহার অনাচারের জন্য ভর্ৎসনা করাতে সে কহিল, “ঠাকুর, আমরা বলি হরি, ওরা বলে আল্লা, কোনো তফাত নেই।” তখন রৌদ্র প্রখর হইয়াছে– বিস্তীর্ণ বালুচর, নদী বহুদূর । রমাপতি পিপাসার ক্লিষ্ট হইয়া কহিল, “হিন্দুর পানীয় জল পাই কোথায় ?” নাপিতের ঘরে একটা কাচা কুপ আছে– কিন্তু ভ্ৰষ্টাচারের সে কূপ হইতে রমাপতি জল থাইতে না পারিয়া মুখ বিমর্ষ করিয়া বসিয়া রছিল । গোর জিজ্ঞাসা করিল, “এ ছেলের কি মা-বাপ নেই ?” নাপিত কহিল, “তুই আছে, কিন্তু না থাকারই মতো ।” গোরা কহিল, “সে কী রকম ?” নাপিত যে ইতিহাসটা বলিল, তাহার মর্ম এই— যে জমিদারিতে ইহারা বাস করিতেছে তাহা নীলকর সাহেবদের ইজার । চরে নীলের জমি লইয়া প্রজাদের সহিত নীলকুঠির বিরোধের অস্ত নাই । অন্ত সমস্ত প্রজা বশ মানিয়াছে কেবল এই চর-ঘোষপুরের প্রজাদিগকে সাহেবরা শাসন করিয়া বাধা করিতে পারে নাই। এখানকার প্রজার সমস্তই মুসলমান এবং ইহাদের প্রধান ফরুলদার কাহাকেও ভয় করে না । নীলকুঠির উৎপাত উপলক্ষে দুই বার পুলিসকে ঠেঙাইয়া সে জেল খাটিয়া আসিয়াছে , তাহার এমন অবস্থা হইয়াছে যে, তাহার ঘরে ভাত নাই বলিলেই হয়, কিন্তু সে কিছুতেই দমিতে জানে না । এবারে নদীর কাচি চরে চাষ দিয়া এ গ্রামের লোকের কিছু বোরো ধান পাইয়াছিল— আজ মাসখানেক হইল নীলকুঠির ম্যানেজার সাহেব স্বয়ং আসিয়া লাঠিয়ালসহ প্রজার ধান লুঠ করে । সেই উৎপাতের সময় ফরুসর্দার সাহেবের ডান হাতে এমন এক লাঠি বলাইয়াছিল যে ডাক্তারখানায় লইয়া গিয় তাহার সেই হাত কাটিয়া ফেলিতে হইয়াছিল । এত বড়ো দুঃসাহসিক ব্যাপার এ অঞ্চলে আর কখনো হয় নাই । ইহার পর হইতে পুলিসের উৎপাত পড়িায় পাড়ায় যেন আগুনের মতে লাগিয়াছে— প্রজাদের কাহারও ঘরে কিছু রাখিল না, ঘরের মেয়েদের ইজ্জত আর থাকে না । ফরুলদার এবং বিস্তর লোককে হাজতে রাপিয়াছে, গ্রামের বহুতর লোক পলাতক হইয়াছে । ফরুর পরিবার আজ নিরন্ন, এমন-কি, তাহার পরনের একখানি মাত্র কাপড়ের এমন দশা হইয়াছে যে, ঘর হইতে সে বাহির হইতে পারিত না ; তাহার একমাত্র বালক-পুত্র