পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৩০২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ఇమe রবীন্দ্র-রচনাবলী সাতকড়ি কহিল, “কাজির আমলে যে ঘুষ দিতেই মাথা বিকিয়ে যেত।” গোরা কহিল, “ঘুষ দেওয়া তে রাজার বিধান ছিল না । যে কাজি মন্দ ছিল সে ঘুষ নিত, এ আমলেও সেটা আছে। কিন্তু এখন রাজদ্বারে বিচারের জন্যে দাড়াতে গেলেই, বাদী হোক প্রতিবাদী হোক, দোষী হোক নির্দোষ হোক, প্রজাকে চোখের জল ফেলতেই হবে । ষে পক্ষ নির্ধন, বিচারের লড়াইয়ে জিত-স্থার দুই তার পক্ষে সর্বনাশ । তার পরে রাজা যখন বাদী আর আমার মতো লোক প্রতিবাদী, তখন তার পক্ষেই উকিল ব্যারিস্টর— আর আমি যদি জোটাতে পারলুম তো ভালো, নইলে অদৃষ্টে যা থাকে । বিচারে যদি উকিলের সাহায্যের প্রয়োজন না থাকে তবে সরকারি উকিল আছে কেন ? যদি প্রয়োজন থাকে তো গবর্মেন্টের বিরুদ্ধপক্ষ কেন নিজের উকিল নিজে জোটাতে বাধ্য হবে ? এ কি প্রজার সঙ্গে শত্রতা ? এ কী রকমের রাজধর্ম ?" সাতকড়ি কহিল, “ভাই, চট কেন ? সিভিলিজেশন সস্তা জিনিস নয়। স্বক্ষ বিচার করতে গেলে সূক্ষ্ম আইন করতে হয়, স্বাক্ষ আইন করতে গেলেই আইনের ব্যবসায়ী না হলে কাজ চলেই না, ব্যবসা চালাতে গেলেই কেনাবেচা এসে পড়ে— অতএব সভ্যতার আদালত আপনিই বিচার-কেনাবেচার হাট হয়ে উঠবেই— যার টাকা নেই তার ঠকবার সম্ভাবনা থাকবেই। তুমি রাজা হলে কী করতে বলে দেখি ” গোরা কহিল, “যদি এমন আইন করতুম যে হাজার দেড়-হাজার টাকা বেতনের বিচারকের বুদ্ধিতেও তার রহস্য ভেদ হওয়া সম্ভব হত না, তা হলে হতভাগা বাদী প্রতিবাদী উভয় পক্ষের জন্য উকিল সরকারি খরচে নিযুক্ত করে দিতুম । বিচার ভালে ছওয়ার খরচা প্রজার ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে স্ববিচারের গৌরব ক’রে পাঠানমোগলদের গাল দিতুম না ।” সাতকড়ি কছিল, “বেশ কথা, সে শুভদিন যখন আসে নি– তুমি যখন রাজা হও নি— সম্প্রতি তুমি যখন সভ্য রাজার আদালতের আসামি— তখন তোমাকে হয় গাটের কড়ি খরচ করতে হবে নয় উকিল বন্ধুর শরণাপন্ন হতে হবে, নয় তো তৃতীয় গতিটা সদ্‌গতি হবে না ।” গোর জেদ করিয়া কহিল, “কোনো চেষ্টা না করে যে গতি হতে পারে আমার সেই গতিই হোক । এ রাজ্যে সম্পূর্ণ নিরুপায়ের যে গতি আমারও সেই গতি ।” বিনয় অনেক অমুনয় করিল, কিন্তু গোরা তাহাতে কর্ণপাত মাত্র করিল না । সে বিনয়কে জিজ্ঞাসা করিল, “তুমি হঠাৎ এখানে কী করে উপস্থিত হলে ?”