পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৩০৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

২৯২ রবীন্দ্র-রচনাবলী সুধীর কহিল, “তার ডিফেন্সের জন্তে তো কোনো বন্দোবস্ত করতে হবে ।” জামিন দিয়া খালাসের চেষ্টা এবং উকিল নিয়োগ সম্বন্ধে গোর যে-সকল আপত্তি করিয়াছিল বিনয় তাহা সমস্তই বলিল— শুনিয়া হারানবাবু অসহিষ্ণু হইয়া কহিলেন, "এ-সমস্ত বাড়াবাড়ি ।” হারানবাবুর প্রতি ললিতার মনের ভাব যাই থাক, সে এপর্যস্ত র্তাহাকে মান্ত করিয়া আসিয়াছে, কখনো তাহার সঙ্গে তর্কে যোগ দেয় নাই— আজ সে তীব্রভাবে মাথা নাড়িয়া বলিয়া উঠিল, “কিছুমাত্র বাড়াবাড়ি নয়— গৌরবাবু যা করেছেন সে ঠিক করেছেন— ম্যাজিস্ট্রেট আমাদের জব্দ করবে আর আমরা নিজেরা নিজেকে রক্ষণ করব ! তাদের মোটা মাইনে যোগাবার জন্তে ট্যাক্স যোগাতে হবে, আবার তাদের হাত থেকে পরিত্রাণ পেতে উকিল-ফী গাট থেকে দিতে হবে । এমন বিচার পাওয়ার চেয়ে জেলে যাওয়! ভালো ।” ললিতাকে হারানবাবু, এতটুকু দেখিয়াছেন— তাহার যে একটা মতামত আছে সে কথা তিনি কোনোদিন কল্পনাও করেন নাই । সেই ললিতার মুখের তীব্র ভাষা শুনিয়া আশ্চর্ষ হইয়া গেলেন ; তাহাকে ভৎসনার স্বরে কহিলেন, “তুমি এ-সব কথার কী বোঝ ? যারা গোটাকতক বই মুখস্থ করে পাস করে সবে কলেজ থেকে বেরিয়ে এসেছে, যাদের কোনো ধর্ম নেই, ধারণা নেই, তাদের মুখ থেকে দায়িত্বহীন উন্মত্ত প্ৰলাপ শুনে তোমাদের মাথা ঘুরে যায় !” এই বলিয়া গতকল্য সন্ধ্যার সময় গোরার সহিত ম্যাজিস্ট্রেটের সাক্ষাং-বিবরণ এবং সে সম্বন্ধে তাহার নিজের সঙ্গে ম্যাজিসট্রেটের আলাপের কথা বিবৃত করিলেন । চর-ঘোষপুরের ব্যাপার বিনয়ের জানা ছিল না। শুনিয়া সে শঙ্কিত হইয়া উঠিল ; বুঝিল, ম্যাজিস্ট্রেট গোরাকে সহজে ক্ষমা করিবে না । হারান যে উদ্দেশ্যে এই গল্পট বলিলেন তাহা সম্পূর্ণ ব্যর্থ হইয়া গেল। তিনি যে গোরার সহিত র্তাহার দেখা হওয়া সম্বন্ধে এতক্ষণ পর্যন্ত একেবারে নীরব ছিলেন তাহার ভিতরকার ক্ষুদ্রতা স্বচরিতাকে আঘাত করিল এবং হারানবাবুর প্রত্যেক কথার মধ্যে গোরার প্রতি যে-একটা ব্যক্তিগত ঈর্ষা প্রকাশ পাইল তাহাতে গোরার এই বিপদের দিনে তাহার প্রতি উপস্থিত প্রত্যেকেরই একটা অশ্রদ্ধা জন্মাইয়া দিল । স্বচরিতা এতক্ষণ চুপ করিয়া ছিল, কী একটা বলিবার জন্ত তাহার আবেগ উপস্থিত হইল, কিন্তু সেটা সম্বরণ করিয়া সে বই খুলিয়া কম্পিত হন্তে পাতা উলটাইতে লাগিল। ললিত উদ্ধতভাবে কছিল, “ম্যাজিস্ট্রেটের সহিত হারানবাবুর মতের যতই মিল থাক, ঘোষপুরের ব্যাপারে গৌরমোহনবাবুর মহত্ব প্রকাশ পেয়েছে।”