পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৩১৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গোরা Öe 3 ললিতার যে পা কঁাপিল এবং বাড়িতে প্রবেশ করিবার সময় সে যে জোর করিয়া নিজেকে একটু শক্ত করিয়া লইল তাহা বিনয় স্পষ্ট বুঝিতে পারিল । ললিতা বোকের মাথায় এবার যে কাজটা করিয়া ফেলিয়াছে তাহার অপরাধ যে কতখানি তাহার ওজন সে নিজে কিছুতেই আন্দাজ করিতে পারিতেছিল না। ললিতা জানিত পরেশবাৰু তাহাকে এমন কোনো কথাই বলিবেন না যাহাকে ঠিক ভৎসনা বলা যাইতে পারে— কিন্তু সেইজন্যই পরেশবাবুর চুপ করিয়া থাকাকেই সে সব চেয়ে ভয় করিত। ললিতার এই সংকোচের ভাব লক্ষ্য করিয়া বিনয় এরূপ স্থলে তাহার কী কর্তব্য ঠিকটি ভাবিয়া পাইল না । সে সঙ্গে থাকিলে ললিতার সংকোচের কারণ অধিক হইবে কি না তাহাই পরীক্ষা করিবার জন্য সে একটু দ্বিধার স্বরে ললিতাকে কহিল, “তবে এখন যাই ।” ললিত তাড়াতাড়ি কহিল, "না, চলুন, বাবার কাছে চলুন ।” ললিতার এই ব্যগ্র অনুরোধে বিনয় মনে মনে আনন্দিত হইয়া উঠিল । বাড়িতে পোছিয়া দিবার পর হইতে তাহার যে কর্তবা শেষ হইয়া যায় নাই, এই একটা আকস্মিক ব্যাপারে ললিতার সঙ্গে তাহার জীবনের যে একটা বিশেষ গ্রন্থিবন্ধন হইয়া গেছে— তাছাই মনে করিয়া বিনয় ললিতার পাশ্বে যেন একটু বিশেষ জোরের সঙ্গে দাড়াইল । তাহার প্রতি ললিতার এই নির্ভর-কল্পনা যেন একটি স্পর্শের মতো তাহার সমস্ত শরীরে বিদ্যুৎ সঞ্চার করিতে লাগিল । তাহার মনে হইল ললিতা যেন তাহার ডান হাত চাপিয়া ধরিয়াছে । ললিতার সহিত এই সম্বন্ধে তাছার পুরুষের বক্ষ ভরিয়া উঠিল । সে মনে মনে ভাবিল, পরেশবাবু ললিতার এই অসামাজিক হঠকারিতায় রাগ করিবেন, ললিতাকে ভৎসনা করিবেন, তখন বিনয় যথাসম্ভব সমস্ত দায়িত্ব নিজের স্বন্ধে লইবে— ভংসনার অংশ অসংকোচে গ্রহণ করিবে, বর্মের স্বরূপ হইয়া ললিতাকে সমস্ত আঘাত হইতে বাচাইতে চেষ্টা করিবে । কিন্তু ললিতার ঠিক মনের ভাবটা বিনয় বুঝিতে পারে নাই। সে ষে ভংসনার প্রতিরোধক-স্বরূপেই বিনয়কে ছাড়িতে চাহিল না তাহা নহে । আসল কথা, ললিতা কিছুই চাপা দিয়া রাধিতে পারে না । সে যাহা করিয়াছে তাহার সমস্ত অংশই পরেশবাবু চক্ষে দেখিবেন এবং বিচারে যে ফল হয় তাহার সমস্তটাই ললিতা গ্রহণ করিবে এইরূপ তাহার ভাব । আজ সকাল হইতেই ললিতা বিনয়ের উপর মনে মনে রাগ করিয়া আছে। রাগটা যে অসংগত তাহা সে সম্পূর্ণ জানে— কিন্তু অসংগত বলিয়াই রাগটা কমে না বরং বাড়ে ।