পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৩১৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

রবীন্দ্র-রচনাবলী اج • (ع সটীমারে যতক্ষণ ছিল ললিতার মনের ভাব অন্তরূপ ছিল । ছেলেবেলা হইতে সে কখনো রাগ করিয়া কখনো জেদ করিয়া একট-না-একটা অভাবনীয় কাণ্ড ঘটাইয়া আসিয়াছে, কিন্তু এবারকার ব্যাপারটি গুরুতর। এই নিষিদ্ধ ব্যাপারে বিনয়ও তাহার সঙ্গে জড়িত হইয়া পড়াতে সে এক দিকে সংকোচ এবং অন্ত দিকে একটা নিগূঢ় হর্ষ অনুভব করিতেছিল। এই হর্ষ যেন নিষেধের সংঘাত-স্বারাই বেশি করিয়া মথিত হইয়া উঠিতেছিল। একজন বাহিরের পুরুষকে সে আজ এমন করিয়া আশ্রয় করিয়াছে, তাহার এত কাছে আসিয়াছে, তাহাদের মাঝখানে আত্মীয়সমাজের কোনো আড়াল নাই, ইহাতে কতখানি কুণ্ঠার কারণ ছিল— কিন্তু বিনয়ের স্বাভাবিক ভদ্রতা এমনি সংযমের সহিত একটি আবরু রচনা করিয়া রাখিয়াছিল যে এই আশঙ্কাজনক অবস্থার মাঝখানে বিনয়ের সুকুমার শীলতার পরিচয় ললিতাকে ভারি একটা আনন্দ দান করিতেছিল । যে বিনয় তাহাদের বাড়িতে সকলের সঙ্গে সর্বদা আমোদ-কৌতুক করিত, যাহার কথার বিরাম ছিল না, বাড়ির ভৃত্যদের সঙ্গেও যাহার আত্মীয়তা অবারিত, এ সে বিনয় নহে । সতর্কতার দোহাই দিয়া যেখানে সে অনায়াসেই ললিতার সঙ্গ বেশি করিয়া লইতে পারিত সেখানে বিনয় এমন দূরত্ব রক্ষা করিয়া চলিয়াছিল যে তাহাতেই ললিত হৃদয়ের মধ্যে তাহাকে আর ৎ নিকটে অনুভব করিতেছিল। রাত্রে সটীমারের ক্যাবিনে নানা চিন্তায় তাহার ভালে ঘুম ইতেছিল না ; ছট্‌ফট্‌ করিতে করিতে এক সময় মনে হইল রাত্রি এতক্ষণে প্রভাত হইয়া আসিয়াছে। ধীরে ধীরে ক্যাবিনের দরজা খুলিয়া বাহিরের দিকে চাহিয়া দেখিল রাত্রিশেষের শিশিরার্ড অন্ধকার তখনো নদীর উপরকার মুক্ত আকাশ এবং তীরের বনশ্রেণীকে জড়াইয় রহিয়াছে— এইমাত্র একটি শতল বাতাস উঠিয়া নদীর জলে কলধ্বনি জাগাইয়া তুলিয়াছে এবং নীচের তলায় এঞ্জিনের খালসিরা কাজ আরম্ভ করিবে এমনতরো চাঞ্চল্যের আভাস পাওয়া যাইতেছে । ললিত ক্যাবিনের বাহিরে আসিয়াই দেখিল, অনতিদূরে বিনয় একটা গরম কাপড় গায়ে দিয়া বেতের চৌকির উপর ঘুমাইয়া পড়িয়াছে। দেখিয়াই ললিতার হৃৎপিণ্ড স্পদিত হইয়া উঠিল । সমস্ত রাত্রি বিনয় ওইখানেই বসিয়া পাহারা দিয়াছে! এত নিকটে, তবু এত দূরে ! ডেক হইতে তখনই ললিত কম্পিতপদে ক্যাবিনে আসিল ; দ্বারের কাছে দাড়াইয়া সেই হেমস্তের প্রত্যুষে সেই অন্ধকারজড়িত অপরিচিত নদীদৃশ্বের মধ্যে একাকী নিদ্রিত বিনয়ের দিকে চাহিয়া রহিল । সম্মুখের দিকপ্রাস্তের তারাগুলি যেন বিনয়ের নিদ্রাকে বেষ্টন করিয়া তাহার চোখে পড়িল একটি অনির্বচনীয় গাম্ভীর্ষে ও মধুর্বে তাহার সমস্ত হৃদয় একেবারে কুলে কুলে পূর্ণ হইয়া উঠিল ; দেখিতে দেখিতে ললিতার দুই চক্ষু কেন যে