পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৩২৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

૭8ર রবীন্দ্র-রচনাবলী তিনি সব দিক দিয়া যত হালকা করিয়া রাখা সম্ভব তাহার চেষ্টা করিতেন। পাছে কেহ বলে “তোমার গোরা হইতে এই ঘটিল, তোমার গোরার জন্য এই কথা শুনিতে হইল’, অথবা ‘তোমার গোরা আমাদের এই লোকসান করিয়া দিল’, আনন্দময়ীর এই এক নিয়ত ভাবনা ছিল । গোরার সমস্ত দায় যে তাহারই । আবার তাহার গোরাও তো সামান্ত দুরস্ত গোরা নয়। যেখানে সে থাকে সেখানে তাহার অস্তিত্ব গোপন করিয়া রাখা তো সহজ ব্যাপার নহে। এই তাহার কোলের খেপ গোরাকে এই বিরুদ্ধ পরিবারের মাঝখানে এতদিন দিনরাত্রি তিনি সামলাইয়। এতবড়ো করিয়া তুলিয়াছেন– অনেক কথা শুনিয়াছেন যাহার কোনো জবাব দেন নাই, অনেক দুঃখ সহিয়াছেন যাহার অংশ আর কাহাকেও দিতে পারেন নাই । আনন্দময়ী চুপ করিয়া জানালার কাছে বসিয়া রহিলেন– দেখিলেন কৃষ্ণায়াল প্রাতঃস্নান সারিয়া ললাটে বাহুতে বক্ষে গঙ্গামূত্তিকার ছাপ লাগাইয়া মন্ত্র উচ্চারণ করিতে করিতে বাড়িতে প্রবেশ করিলেন, তাহার কাছে আনন্দময়ী যাইতে পারলেন না । নিষেধ, নিষেধ, নিষেধ, সর্বত্রই নিষেধ ! অবশেষে নিশ্বাস ফেলিয়া আনন্দময়ী উঠিয়া মহিমের ঘরে গেলেন । মহিম তখন মেঝের উপর বসিয়। খবরের কাগজ পড়িতেছিলেন এবং তাছার ভূত্য স্বানের পূর্বে তাহার গায়ে তেল মালিশ করিয়া নিতেছিল । আনন্দময়ী তাহাকে কহিলেন, "মহিম, তুমি আমার সঙ্গে এক জন লোক দাও, আমি যাই গোরার কী হল দেখে আসি । সে জেলে যাবে বলে মনস্থির করে বসে আছে ; যদি তার জেল হয় আমি কি তার আগে তাকে একবার দেখে আসতে পারব না ?” মহিমের বাহিরের ব্যবহার যেমনি হউক, গোরার প্রতি র্তাহার এক প্রকারের স্নেহ ছিল । তিনি মুখে গর্জন করিয়া গেলেন যে, “যাক লক্ষ্মীছাড় জেলেই যাক— এতদিন যায় নি এই আশ্চর্য ।” এই বলিয়া পরক্ষণেই উহাদের অমুগত পরান ঘোষালকে ডাকিয় তাহার হাতে উকিল-খরচার কিছু টাক দিয়। তখনি তাহকে রওনা করিয়া দিলেন এবং আপিসে গিয়া সাহেবের কাছে ছুটি যদি পান এবং বউ যদি সম্মতি দেন তবে নিজেও সেখানে যাইবেন স্থির করিলেন । আনন্দময়ীও জানিতেন, মহিম গোরার জন্য কিছু না করিয়া কপনো থাকিতে পরিবেন না । মহিম যথাসম্ভব ব্যবস্থা করিয়াছেন শুনিল্লা তিনি নিজের ঘরে ফিরিয়া আসিলেন । তিনি স্পষ্টই জানিতেন, গোর যেখানে আছে সেই অপরিচিত স্থানে এই ংকটের সময় লোকের কৌতুক কৌতুঙ্গল ও আলোচনার মুখে তাছাকে সঙ্গে করিয়া লইয়া যাইবে এ পরিবারে এমন কেহই নাই। তিনি চোখের দৃষ্টিতে নিশা বেদনার