পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৩২৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

\S)ა8 রবীন্দ্র-রচনাবলী গোরাকেও সেই দণ্ড দেওয়া ম্যাজিস্ট্রেটের পক্ষে যে সমান অনায়াসসাধ্য হইয়াছে এরূপ বর্বরতা নিতান্তই ধর্মবুদ্ধির অসাড়তাবশত সম্ভবপর হইতে পারিয়াছে। মানুষের প্রতি মামুষের দৌরাত্ম্য জগতের অন্য সমস্ত হিংস্রতার চেয়ে যে কত ভয়ানক— তাহার পশ্চাতে সমাজের শক্তি, রাজার শক্তি দলবদ্ধ হইয় দাড়াইয় তাহাকে যে কিরূপ প্রচণ্ড প্রকাও করিয়া তুলিয়াছে, গোরার কারাদণ্ডের কথা শুনিয়া তাহা তাহার চোখের সম্মুখে প্রত্যক্ষ হইয়া উঠিল । পরেশবাবুকে এইরূপ চুপ করিয়া ভাবিতে দেখিয়া ললিতা উৎসাহিত হইয়া বলিয়া উঠিল, “আচ্ছা, বাবা, এ ভয়ানক অন্যায় নয় ?” পরেশবাবু তাহার স্বাভাবিক শাস্তম্বরে কহিলেন, "গৌর যে কতখানি কী করেছে সে তো আমি ঠিক জানি নে ; তবে এ কথা নিশ্চয় বলতে পারি, গেীর তার কর্তব্যবুদ্ধির প্রবলতার ঝোঁকে হয়তে হঠাৎ আপনার অধিকারের সীমা লঙ্ঘন করতে পারে, কিন্তু ইংরেজী ভাষায় যাকে ক্রাইম বলে তা যে গেরিার পক্ষে একেবারেই প্রকৃতিবিরুদ্ধ তাতে আমার মনে লেশমাত্র সন্দেহ নেই। কিন্তু কী করবে মা, কালের ন্যায়বুদ্ধি এখনো সে পরিমাণে বিবেক লাভ করে নি। এখনো অপরাধের যে দণ্ড ক্রটিরও সেই দণ্ড ; উভয়কেই একই জেলের একই ঘানি টানতে হয় । এরকম যে সম্ভব হয়েছে কোনো এক জন মানুষকে সেজন্য দোষ দেওয়া যায় না । সমস্ত মামুষের পাপ এজন্য দায়ী ।” হঠাৎ এই প্রসঙ্গ বন্ধ করিয়া পরেশবাবু জিজ্ঞাসা করিয়া উঠিলেন, “তুমি কার সঙ্গে এলে ?” ললিত বিশেষ একটু জোর করিয়া যেন খাড়া হইয়া কহিল, ‘বিনয়বাবুর সঙ্গে ।” বাহিরে যতই জোর দেখাক তাহার ভিতরে দুর্বলতা ছিল । বিনয়বাবুর সঙ্গে আসিয়াছে এ কথাটা ললিতা বেশ সহজে বলিতে পারিল না— কোথা হইতে একটু লজ্জা আসিয়া পড়িল এবং সে লজ্জ মুখের ভাবে বাহির হইয়া পড়িতেছে মনে করিয়া তাহার লজ্জা আরও বাড়িয়া উঠিল । পরেশবাবু এই খামখেয়ালি দুর্জয় মেয়েটিকে তাহার অন্যান্য সকল সস্তানের চেয়ে একটু বিশেষ স্নেহই করিতেন । ইহার ব্যবহার অন্যের কাছে নিন্দনীয় ছিল বলিয়াই ললিতার আচরণের মধ্যে যে একটি সত্যপরতা আছে সেইটিকে তিনি বিশেষ করিয়া শ্রদ্ধা করিয়াছেন । তিনি জানিতেন ললিতার যে দোষ সেইটেই বেশি করিয়া লোকের চোখে পড়িবে, কিন্তু ইহার যে গুণ তাহা যতই দুর্লভ হউক-না কেন লোকের কাছে আদর পাইবে না। পরেশবাবু সেই গুণটিকে যত্বপূর্বক সাবধানে আশ্রয় দিয়া