পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৩২৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গোর ○>Q আসিয়াছেন, ললিতার দুরস্ত প্রকৃতিকে দমন করিয়া সেইসঙ্গে তাহার ভিতরকার মহত্বকেও দলিত করিতে তিনি চান নাই । তাহার অন্ত দুইটি মেয়েকে দেখিবামাত্রই সকলে স্বন্দরী বলিয়া স্বীকার করে ; তাহাদের বর্ণ উজ্জল, তাহদের মুথের গড়নেও খুত নাই— কিন্তু ললিতার রঙ তাহদের চেয়ে কালো, এবং তাহার মুখের কমনীয়তা সম্বন্ধে মতভেদ ঘটে। বরদাসুন্দরী সেইজন্য ললিতার পাত্র জোটা লইয়া সর্বদাই স্বামীর নিকট উদবেগ প্রকাশ করিতেন। কিন্তু পরেশবাবু ললিতার মুখে যে-একটি সৌন্দর্য দেখিতেন তাহা রঙের সৌন্দর্য নহে, গড়নের সৌন্দর্য নহে, তাহা অস্তরের গভীর সৌন্দর্য । তাহার মধ্যে কেবল লালিত্য নহে, স্বাতন্ত্র্যের তেজ এবং শক্তির দৃঢ়তা আছে— সেই দৃঢ়তা সকলের মনোরম নহে । তাহা লোকবিশেষকে আকর্ষণ করে, কিন্তু অনেককেই দূরে ঠেলিয়া রাখে। সংসারে ললিত প্রিয় হইবে না, কিন্তু খাটি হইবে ইহাই জানিয়া পরেশবাবু কেমন একটু বেদনার সহিত ললিতাকে কাছে টানিয়া লইতেন— তাহাকে আর-কেহ ক্ষমা করিতেছে না জানিয়াই তাহাকে করুণার সহিত বিচার করিতেন । যখন পরেশবাবু শুনিলেন ললিত একলা বিনয়ের সঙ্গে হঠাৎ চলিয়া আসিয়াছে, তখন তিনি এক মুহূর্তেই বুঝিতে পারিলেন এজন্য ললিতাকে অনেক দিন ধরিয়া অনেক দুঃখ সহিতে হইবে ; সে যেটুকু অপরাধ করিয়াছে লোকে তাহার চেয়ে বড়ো অপরাধের দণ্ড তাহার প্রতি বিধান করিবে। সেই কথাটা তিনি চুপ করিয়া ক্ষণকাল ভাবিতেছেন, এমন সময় ললিত বলিয়া উঠিল, “বাবা, আমি দোষ করেছি। কিন্তু এবার আমি বেশ বুঝতে পেরেছি যে, ম্যাজিস্ট্রেটের সঙ্গে আমাদের দেশের লোকের এমন সম্বন্ধ যে তার আতিথ্যের মধ্যে কিছুই সম্মান নেই, কেবলই অনুগ্রহ মাত্র। সেটা সহ করেও কি আমার সেখানে থাকা উচিত ছিল ?” পরেশবাবুর কাছে প্রশ্নটি সহজ বলিয়া বোধ হইল না। তিনি কোনো উত্তর দিবার চেষ্টা না করিয়া একটু হাসিয়া ললিতার মাথায় দক্ষিণ হস্ত দিয়া মুন্থ আঘাত করিয়া বলিলেন, "পাগলী !” এই ঘটনা সম্বন্ধে চিস্তা করিতে করিতে সেদিন অপরাহ্লে পরেশবাবু যখন বাড়ির বাহিরে পায়চারি করিতেছিলেন এমন সময় বিনয় আসিয়া তাহাকে প্রণাম করিল। পরেশবাবু গোরার কারাদণ্ড লম্বন্ধে তাহার সঙ্গে অনেক ক্ষণ ধরিয়া আলোচনা করিলেন, কিন্তু ললিতার সঙ্গে স্টীমারে আসার কোনো প্রসঙ্গই উত্থাপন করিলেন না । অন্ধকার হইয়া আসিলে কহিলেন, "চলো, বিনয়, ঘরে চলো ।” বিনয় কহিল, “না, আমি এখন বাসায় যাব।”