পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৩৩৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গোরা ৩২৭ এই বলিয়া আনন্দময়ী এক বার ললিতার ও এক বার স্বচরিতার চিবুক স্পর্শ করিয়া অঙ্গুলিদ্বারা চুম্বন গ্রহণ করিলেন। স্বচরিতা বিনয়ের দুরবস্থা লক্ষ্য করিয়া সময়চিত্তে কহিল, “বিনয়বাবু, বাবা এসেছেন ; তিনি বাইরে কৃষ্ণদয়ালবাবুর সঙ্গে কথা কচ্ছেন।” | শুনিয়া বিনয় তাড়াতাড়ি বাহিরে চলিয়া গেল। তখন গোর ও বিনয়ের অসামান্ত বন্ধুত্ব লইয়া আনন্দময়ী আলোচনা করিতে লাগিলেন । শ্রোতা দুই জনে যে উদাসীন নছে তাহা বুঝিতে র্তাহার বাকি ছিল না। আনন্দময়ী জীবনে এই দুটি ছেলেকেই তাহার মাতৃস্নেহের পরিপূর্ণ অৰ্ঘ্য দিয়া পূজা করিয়া আসিয়াছেন, সংসারে ইহাদের চেয়ে বড়ে তাহার আর কেহ ছিল না। বালিকার পূজার শিবের মতো ইহাদিগকে তিনি নিজের হাতেই গড়িয়াছেন বটে, কিন্তু ইহারাই তাহার সমস্ত আরাধনা গ্রহণ করিয়াছে। তাছার মুখে তাহার এই দুটি ক্রোড়দেবতার কাহিনী স্নেহুরসে এমন মধুর উজ্জল হইয়া উঠিল যে স্বচরিতা এবং ললিতা অতৃপ্তহৃদয়ে শুনিতে লাগিল । গোরা এবং বিনয়ের প্রতি তাহাদের শ্রদ্ধার অভাব ছিল না, কিন্তু আনন্দময়ীর মতো এমন মায়ের এমন মেহের ভিতর দিয়া তাহদের সঙ্গে যেন আর একটু বিশেষ করিয়া, নূতন করিয়া পরিচয় হইল। আনন্দময়ীর সঙ্গে আজ জানাশুনা হইয়া ম্যাজিস্ট্রেটের প্রতি ললিতার রাগ আরও যেন বাড়িয়া উঠিল । ললিতার মুখে উষ্ণবাক্য শুনিয়া আনন্দময়ী হাসিলেন। কহিলেন, “মা, গোরা আজ জেলখানায়, এ দুঃখ ষে আমাকে কী রকম বেজেছে তা অন্তর্যামীই জানেন । কিন্তু সাহেবের উপর আমি রাগ করতে পারি নি আমি তো গোরাকে জানি, সে যেটাকে ভালো বোঝে তার কাছে আইনকামুন কিছুই মানে না ; যদি না মানে তবে যারা বিচারকর্তা তারা তো জেলে পাঠাবেই— তাতে তাদের দোষ দিতে যাবে কেন ? গোরার কাজ গোরা করেছে— ওদের কর্তব্য ওরা করেছে— এতে যাদের দুঃখ পাবার তারা দুঃখ পাবেই। আমার গোরার চিঠি যদি পড়ে দেখ, মা, তা হলে বুঝতে পারবে ও দুঃখকে ভয় করে নি, কারও উপর মিথ্যে রাগও করে নি— যাতে যা ফল হয় তা সমস্ত নিশ্চয় জেনেই কাজ করেছে।” * এই বলিয়া গোরার সযত্বরক্ষিত চিঠিখানি বাক্স হইতে বাহির করিয়া স্বচরিতার হাতে দিলেন। কহিলেন, “ম, তুমি চেচিয়ে পড়ে, আমি আর-এক বার শুনি ।” গোরার সেই আশ্চর্য চিঠিখানি পড়া হইয়া গেলে পর তিন জনেই কিছুক্ষণ নিস্তব্ধ হইয়া রছিলেন। আনন্দময়ী তাহার চোখের প্রাস্ত আঁচল দিয়া মুছিলেন। সে যে চোখের জল তাহাতে শুধু মাতৃহৃদয়ের ব্যথা নহে, তাহার সঙ্গে আনন্দ এবং গৌরব . ૭૨ છે