পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৩৪৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গোরা HOS বিনয় ললিতার দিকে আড় করিয়া কোনোমতে দূরে এক জায়গায় বসিল । যেন বিনয়ের প্রতি তাহার ব্যবহারের কোনো বৈলক্ষণ্য হয় নাই এমনি সহজভাবে ললিত কহিল, “বিনয়বাবু, আপনার বন্ধু সতীশকে আপনি একেবারে ত্যাগ করেছেন কি না জানবার জন্যে সে আজ সকালে আপনার বাড়ি গিয়েছিল যে ” হঠাৎ দৈববাণী হইলে মানুষ যেমন আশ্চর্য হইয়া যায় সেইরূপ বিস্ময়ে বিনয় চমকিয়া উঠিল । তাহার সেই চমকটা দেখা গেল বলিয়া সে অত্যস্ত লজ্জিত হইল । তাহার স্বভাবসিদ্ধ নৈপুণ্যের সঙ্গে কোনো জবাব করিতে পারিল না ; মুখ ও কর্ণমূল লাল করিয়া কহিল, “সতীশ গিয়েছিল না কি ? আমি তো বাড়িতে ছিলুম না ।” ললিতার এই সামান্ত একটা কথায় বিনয়ের মনে একটা অপরিমিত আনন্দ জন্মিল । এক মুহূর্তে বিশ্বজগতের উপর হইতে একটা প্রকাও সংশয় যেন নিশ্বাসরোধকর দুঃস্বপ্নের মতো দূর হইয়া গেল ! যেন এইটুকু ছাড়া পৃথিবীতে তাহার কাছে প্রার্থনীয় আর কিছু ছিল না। তাহার মন বলিতে লাগিল— ‘র্বাচিলাম, বচিলাম’ । ললিতা রাগ করে নাই, ললিত তাহার প্রতি কোনো সন্দেহ করিতেছে না । দেখিতে দেখিতে সমস্ত বাধা কাটিয়া গেল। স্বচরিতা হাসিয়া কহিল, “বিনয়বাৰু হঠাৎ আমাদের নধী দন্তী শৃঙ্গী অস্ত্রপাণি কিম্ব ঐরকম একটা-কিছু ব’লে সন্দেহ করে বসেছেন !” 較 বিনয় কহিল, “পৃথিবীতে ধারা মুখ ফুটে নালিশ করতে পারে না, চুপ করে থাকে, তারাই উলটে আসামি হয়। দিদি, তোমার মুখে এ কথা শোভা পায় না,– তুমি নিজে কত দূরে চলে গিয়েছ এখন অন্তকে দূর বলে মনে করছ।” বিনয় আজ প্রথম স্বচরিতাকে দিদি বলিল। স্বচরিতার কানে তাহা মিষ্ট লাগিল, বিনয়ের প্রতি প্রথম পরিচয় হইতেই স্বচরিতার যে একটি সৌহৃদ্য জন্মিয়াছিল এই দিদি সম্বোধন মাত্রেই তাহা যেন একটি স্নেহপূর্ণ বিশেষ আকার ধারণ করিল। পরেশবাবু তাহার মেয়েদের লইয়া যখন বিদায় লইয়া গেলেন তখন দিন প্রায় শেষ হইয়া গেছে । বিনয় আনন্দময়ীকে কহিল, “মা, আজ তোমাকে কোনো কাজ করতে দেব না। চলো উপরের ঘরে ।” বিনয় তাহার চিত্তের উর্দুবেলতা সম্বরণ করিতে পারিতেছিল না । আনন্দময়ীকে উপরের ঘরে লইয়া গিয়া মেঝের উপরে নিজের হাতে মাদুর পাতিয়া তাহাকে বসাইল । আনন্দময়ী বিনয়কে জিজ্ঞাসা করিলেন, “বিহু, কী, তোর কথাটা কী ?” বিনয় কছিল, “আমার কোনো কথা নেই, তুমি কথা বলে ।”