পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৩৮০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

iš রবীন্দ্র-রচনাবলী سواناتي সে র্তাহার জীবনের, এমন-কি তাহার ঈশ্বরোপাসনার সঙ্গে জড়িত হইয়া গিয়াছিল। যেদিন সে নিঃশব্দে আলিয়। র্তাহার উপাসনার সহিত যোগ দিত সেদিন তাহার উপাসনা যেন বিশেষ পূর্ণতা লাভ করিত। প্রতিদিন স্বচরিতার জীবনকে মঙ্গলপূর্ণ স্নেহের দ্বারা গড়িতে গড়িতে তিনি নিজের জীবনকে একটি বিশেষ পরিণতি দান করিতেছিলেন । স্বচরিতা যেমন ভক্তি যেমন একান্ত নম্রতার সহিত র্তাহার কাছে আসিয়া দাড়াইয়াছিল এমন করিয়া আর-কেহ তাহার কাছে আসে নাই ; ফুল যেমন করিয়া আকাশের দিকে তাকায় সে তেমনি করিয়া তাহার দিকে তাহার সমস্ত প্রকৃতিকে উন্মুখ এবং উদঘাটিত করিয়া দিয়াছিল । এমন একাগ্রভাবে কেহ কাছে আসিলে মামুষের দান করিবার শক্তি আপনি বাড়িয়া যায়— আন্ত:করণ জলভারনম্র মেঘের মতো পরিপূর্ণতার দ্বারা নত হইয়া পড়ে। নিজের যাহা-কিছু সত্য, যাহ+ কিছু শ্রেষ্ঠ তাহা কোনো অমুকুল চিত্তের নিকট প্রতিদিন দান করিবার স্বযোগের মতো এমন শুভযোগ মানুষের কাছে আর-কিছু হইতেই পারে না ; সেই দুর্লভ স্বযোগ স্বচরিতা পরেশকে দিয়াছিল । এজন্য স্বচরিতার সঙ্গে তাহার সম্বন্ধ অত্যন্ত গভীর হইয়াছিল । আজ সেই স্বচরিতার সঙ্গে তাহার বাহ সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করিবার সময় উপস্থিত হইয়াছে— ফলকে নিজের জীবনরসে পরিপক্ক করিয়া তুলিয়া তাহাকে নিজের নিকট হইতে মুক্ত করিয়া দিতে হইবে । এজন্য তিনি মনের মধ্যে যে বেদনা অনুভব করিতেছিলেন সেই নিগুঢ় বেদনটিকে তিনি অন্তর্যামীর নিকট নিবেদন করিয়া দিতেছিলেন । স্বচরিতার পাথেয় সঞ্চয় হইয়াছে, এখন নিজের শক্তিতে প্রশস্ত পথে স্থখে-দুঃখে আঘাত-প্রতিঘাতে নূতন অভিজ্ঞতা লাভের দিকে ষে তাহার আহবান আসিয়াছে তাহার আয়োজন কিছুদিন হইতেই পরেশ লক্ষ্য করিতেছিলেন ; তিনি মনে মনে বলিতেছিলেন, ‘বংসে, যাত্রা করো— তোমার চিরজীবন যে কেবল আমার বুদ্ধি এবং আমার আশ্রয়ের দ্বারাই আচ্ছন্ন করিয়া রাখিব এমন কখনোই হইতে পারিবে না— ঈশ্বর আমার নিকট হইতে তোমাকে মুক্ত করিয়া বিচিত্রের ভিতর দিয়া তোমাকে চরম পরিণামে আকর্ষণ করিয়া লইয়া যান— তাহার মধ্যে তোমার জীবন সার্থক হউক ।’ এই বলিয়া আশৈশব-স্নেহপালিত স্বচরিতাকে তিনি মনের মধ্যে নিজের দিক হইতে ঈশ্বরের দিকে পবিত্র উৎসর্গসামগ্রীর মতো তুলিয়া ধরিতেছিলেন। পরেশ বরদাসুন্দরীর প্রতি রাগ করেন নাই, নিজের সংসারের প্রতি মনকে কোনোপ্রকার বিরোধ অনুভব করিতে প্রশ্রয় দেন নাই । তিনি জানিতেন সংকীর্ণ উপকূলের মাঝখানে নূতন বর্ষণের জলরাশি হঠাৎ আলিয়া পড়িলে অত্যন্ত একটা ক্ষোভের স্বষ্টি হয়— তাহার একমাত্র প্রতিকায় ।