পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৩৮৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গোরা ७११ আমাদের বাড়ি থেকে যাবে— আজ সকালে আমি কোনোরকম অশাস্তি ঘটতে দিতে পারব না । হারানবাবু, আমাদের যতই অপরাধ থাক, তবু আজকের মতো আমাদের মাপ করতে হবে ।” হারান চুপ করিয়া গম্ভীর হইয়া বসিয়া রছিলেন। স্বচরিতা যতই তাঁহাকে বর্জন করিতেছিল স্বচরিতাকে ধরিয়া রাখিবার জেদ ততই তাহার বাড়িয়া উঠিতেছিল। তাছার ধ্রুব বিশ্বাস ছিল অসামান্ত নৈতিক জোরের দ্বারা তিনি নিশ্চয়ই জিতিবেন । এপনো তিনি যে হাল ছাড়িয়া দিয়াছেন তাহা নহে, কিন্তু মাসির সঙ্গে সুচরিতা অন্য বাড়িতে গেলে সেখানে তাহার শক্তি প্রতিহত হইতে থাকিবে এই আশঙ্কায় তাহার মন ক্ষুব্ধ ছিল । এইজন্য আজ র্তাহার ব্রহ্মাস্ত্রগুলিকে শান দিয়া আনিয়াছিলেন । কোনোমতে আজ সকালবেলাকার মধ্যেই খুব কড়া রকম করিয়া বোঝাপড়া করিয়৷ লইতে তিনি প্রস্তুত ছিলেন । আজ সমস্ত সংকোচ তিনি দূর করিয়াই আসিয়াছিলেন— কিন্তু অপর পক্ষেও যে এমন করিয়া সংকোচ দূর করিতে পারে, ললিতা স্বচরিতাও যে হঠাৎ তৃণ হইতে অস্ত্র বাহির করিয়া দাড়াইবে তাহা তিনি কল্পনাও করেন নাই । তিনি জানিতেন, তাহার নৈতিক অগ্নিবাণ যখন তিনি মহাতেজে নিক্ষেপ করিতে থাকিবেন অপর পক্ষের মাথা একেবারে হেঁট হইয়া যাইবে । ঠিক তেমনটি হইল না— অবসরও চলিয়া গেল । কিন্তু হারানবাবু হার মানিবেন না । তিনি মনে মনে কহিলেন, সত্যের জয় হইবেই, অর্থাং হারানবাবুর জয় হইবেই। কিন্তু জয় তো শুধু শুধু হয় না। লড়াই করিতে হইবে । হারানবাবু কোমর বাধিয়া রণক্ষেত্রে প্রবেশ করিলেন। স্বচরিতা কহিল, “মালি, আজ আমি সকলের সঙ্গে একসঙ্গে খাব— তুমি কিছু মনে করলে চলবে না।” হরিমোহিনী চুপ করিয়া রহিলেন। তিনি মনে মনে স্থির করিয়াছিলেন স্বচরিতা সম্পূর্ণই তাহার হইয়াছে--বিশেষত নিজের সম্পত্তির জোরে স্বাধীন হইয়া সে স্বতন্ত্র ঘর করিতে চলিয়াছে, এখন হরিমোহিনীকে আর কোনো সংকোচ করিতে হইবে না, ষোলো আনা নিজের মতো করিয়া চলিতে পারিবেন। তাই, আজ যখন স্বচরিতা শুচিত বিসর্জন করিয়া আবার সকলের সঙ্গে একত্রে অন্নগ্রহণ করিবার প্রস্তাব করিল তখন তাহার ভালো লাগিল না, তিনি চুপ করিয়া রহিলেন । স্বচরিতা তাহার মনের ভাব বুঝিয়া কহিল, “আমি তোমাকে নিশ্চয় বলছি এতে ঠাকুর খুশি হবেন। সেই আমার অন্তর্যামী ঠাকুর আমাকে সকলের সঙ্গে আজ একসঙ্গে খেতে বলে দিয়েছেন । র্তার কথা না মানলে তিনি রাগ করবেন। তার রাগকে আমি তোমার রাগের চেয়ে ভয় করি।”