পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৩৯১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গোরা פרס অনুরোধে’ পরের স্খলন লইয়া ঘৃণা প্রকাশ ও দগুবিধান করিতে উষ্ঠত হই, তখন সত্যের ও কর্তব্যের অনুরোধ রক্ষা করা আমাদের পক্ষে অত্যন্ত ক্লেশকর হয় না । এই জন্য ব্রাহ্মসমাজে হারানবাবু যখন ‘অপ্রিয় সত্য ঘোষণা ও কঠোর কর্তব্য সাধন করিতে প্রবৃত্ত হইলেন তখন এত বড়ো অপ্রিয়তা ও কঠোরতার ভয়ে তাহার সঙ্গে উৎসাহের সহিত যোগ দিতে অধিকাংশ লোক পরাস্মুখ হইল না। ব্রাহ্মসমাজের হিতৈষী লোকেরা গাড়ি-পালকি ভাড়া করিয়া পরস্পরের বাড়ি গিয়া বলিয়া আসিলেন, আজকাল যখন এমন-সকল ঘটনা ঘটিতে আরম্ভ করিয়াছে তখন ব্রাহ্মসমাজের ভবিষ্যৎ অত্যন্ত অন্ধকারাচ্ছন্ন । এই সঙ্গে, স্বচরিতা যে হিন্দু হইয়াছে এবং হিন্দু মাসির ঘরে আশ্রয় লইয়া যাগযজ্ঞ তপ জপ ও ঠাকুরসেবা লইয়া দিন যাপন করিতেছে, এ কথাও পল্লবিত হইয়া উঠিতে লাগিল । অনেক দিন হইতে ললিতার মনে একটা লড়াই চলিতেছিল। সে প্রতি রাত্রে শুইতে যাইবার আগে বলিতেছিল কখনোই আমি হার মানিব না’ এবং প্রতিদিন ঘুম ভাঙিয়। বিছানায় বসিয়া বলিয়াছে ‘কোনোমতেই আমি হরি মানিব না’ । এই-যে বিনয়ের চিস্তা তাহার সমস্ত মনকে অধিকার করিয়া বসিয়াছে, বিনয় নীচের ঘরে বসিয়া কথা কহিতেছে জানিতে পারিলে তাহার হৃৎপিণ্ডের রক্ত উতলা হইয়া উঠিতেছে, বিনয় দুই দিন তাহাদের বাড়িতে না আসিলে অবরুদ্ধ অভিমানে তাহার মন নিপীড়িত হইতেছে, মাঝে মাঝে সতীশকে নানা উপলক্ষ্যে বিনয়ের বাসায় যাইবার জন্ত উৎসাহিত করিতেছে এবং সতীশ ফিরিয়া আসিলে বিনয় কী করিতেছিল, বিনয়ের সঙ্গে কী কথা হইল, তাহার আদ্যোপাস্ত সংবাদ সংগ্ৰহ করিবার চেষ্টা করিতেছে— ইহা ললিতার পক্ষে যতই অনিবার্য হইয়া উঠিতেছে ততই পরাভবের গ্লানিতে তাহাকে অধীর করিয়া তুলিতেছে। বিনয় ও গোরার সঙ্গে আলাপ-পরিচয়ে বাধা দেন নাই বলিয়৷ এক এক বার পরেশবাবুর প্রতি তাহার রাগও হইত। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সে লড়াই করিলে, মরিবে তবু হারিবে না, এই তাহার পণ ছিল । জীবন যে কেমন করিয়া কাটাইবে সে সম্বন্ধে নানাপ্রকার কল্পনা তাহার মনের মধ্যে যাতায়াত করিতেছিল। যুরোপের লোকহিতৈষিণী রমণীদের জীবনচরিতে যে-সকল কীর্তিকাহিনী সে পাঠ করিয়াছিল সেইগুলি তাহার নিজের পক্ষে সাধ্য ও সম্ভবপর বলিয়া মনে হইতে লাগিল । এক দিন সে পরেশবাবুকে গিয়া কহিল, "বাবা, আমি কি কোনো মেয়ে-ইস্কুলে শেখাবার ভার নিতে পারি নে ?” পরেশবাবু তাহার মেয়ের মুখের দিকে চাহিয়া দেখিলেন, ক্ষুধাতুর হৃদয়ের বেদনায়