পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৪০০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

রবীন্দ্র-রচনাবলী "ל"לס\ 86. বিনয় যেখানে এই কয়দিন অতিথিরূপে ও বন্ধুরূপে এমন নিশ্চিন্তভাবে পদার্পণ করিয়াছিল তাহার তলদেশে সামাজিক আগ্নেয়গিরি এমন সচেষ্টভাবে উত্তপ্ত হইয়া আছে তাহা সে স্বপ্নেও জানিত না। প্রথম যখন সে পরেশবাবুর পরিবারের সঙ্গে মিশিতেছিল তখন তাহার মনে যথেষ্ট সংকোচ ছিল ; কোথায় কতদূর পর্যন্ত তাহার অধিকারের সীমা তাহা সে নিশ্চিত জানিত না বলিয়া সর্বদা ভয়ে ভয়ে চলিত। ক্রমে যখন তাহার ভয় ভাঙিয়া গেল তখন কোথাও যে কিছুমাত্র বিপদের শঙ্কা আছে তাহা তাহার মনেও হয় নাই । আজ হঠাৎ যখন শুনিল তাহার ব্যবহারে সমাজের লোকের নিকট ললিতাকে নিন্দিত হইতে হইতেছে তখন তাহার মাথায় বজ্ৰ পড়িল । বিশেষত সকলের চেয়ে তাহার ক্ষোভের কারণ হইল এইজন্য যে, ললিতার সম্বন্ধে তাহার হৃদয়ের উত্তাপমাত্রা সাধারণ বন্ধুত্বের রেখা ছাড়াইয়া অনেক উর্ধ্বে উঠিয়াছিল তাহ সে নিজে জানিত এবং বর্তমান ক্ষেত্রে যেখানে পরস্পরের সমাজ এমন বিভিন্ন সেখানে এরূপ তাপাধিক্যকে সে মনে মনে অপরাধ বলিয়াই গণ্য করিত । সে অনেক বার মনে করিয়াছে এই পরিবারের বিশ্বস্ত অতিথিরূপে আসিয়া সে নিজের ঠিক স্থানটি রাথিতে পারে নাই— এক জায়গায় সে কপটতা করিতেছে ; তাহর মনের ভাবটি এই পরিবারের লোকের কাছে ঠিকমতো প্রকাশ পাইলে তাহার পক্ষে লজ্জার কারণ হইবে । এমন সময় যখন এক দিন মধ্যাহ্নে বরদাসুন্দরী পত্র লিখিয়া বিনয়কে বিশেষ করিয়া ডাকিয়া আনিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন— ‘বিনয়বাবু, আপনি তো হিন্দু ? এবং বিনয় তাহ স্বীকার করিলে পুনরায় প্রশ্ন করিলেন— ‘হিন্দুসমাজ আপনি তো ত্যাগ করিতে পরিবেন না ? এবং বিনয় তাহা তাহার পক্ষে অসম্ভব জানাইলে বরদাসুন্দরী যখন বলিয়া উঠিলেন তবে কেন আপনি – তপন সেই তবে-কেন'র কোনো উত্তর বিনয়ের মুখে জোগাইল না । সে একেবারে মাথা হেঁট করিয়া বসিয়া রছিল। তাহার মনে হুইল সে যেন ধরা পড়িয়াছে ; তাহার এমন একটা জিনিস এখানে সকলের কাছে প্রকাশ হইয়া পড়িয়াছে যাহ। সে চন্দ্ৰস্থৰ্যবায়ুর কাছেও গোপন করিতে চাহিয়াছিল । তাহার কেবলই মনে হইতে লাগিল— পরেশবাবু কী মনে করিতেছেন, ললিত কী মনে করিতেছে, স্বচরিতাই বা তাহাকে কী ভাবিতেছে! দেবদূতের কোন ভ্রমক্রমে এই-যে স্বৰ্গলোকে কিছুদিনের মতো তাহার স্থান হইয়াছিল— অনধিকারপ্রবেশের সমস্ত লজ্জ মাথায় করিয়া লইয়া এধান হইতে আজ তাহাকে একেবারে নির্বাসিত হইতে হইবে ।