পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৪২২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8× o রবীন্দ্র-রচনাবলী আনন্দময়ী কহিলেন, “তোর তো অতশত কথা ভাববার দরকার দেখি নে । তোর তরফ থেকে তুই যেটুকু করতে পারিস সেইটুকু করলেই চুকে গেল। তুই বলতে পারিস ‘আমি বিবাহ করতে প্রস্তুত আছি ।” বিনয় কছিল, “আমি এমন অসংগত কথা বললে সেটা ললিতার পক্ষে কি অপমানকর হবে না ?” আনন্দময়ী কহিলেন, “অসংগত কেন বলছিল ? তোদের বিবাহের গুজব যখন উঠে পড়েছে তখন নিশ্চয়ই সেটা সংগত ব’লেই উঠেছে । আমি তোকে বলছি তোর কিছু সংকোচ করতে হবে না।” বিনয় কহিল, "কিন্তু মা, গোরার কথাও তো ভাবতে হয় ।” আনন্দময়ী দৃঢ়স্বরে কহিলেন, “না বাছা, এর মধ্যে গোরার কথা ভাববার কথাই নয়। আমি জানি সে রাগ করবে— আমি চাই নে যে সে তোর উপরে রাগ করে । কিন্তু কী করবি, ললিতার প্রতি যদি তোর শ্রদ্ধা থাকে তবে তার সম্বন্ধে চিরকাল সমাজে একটা অপমান থেকে যাবে এ তো তুই ঘটতে দিতে পারিস নে ৷” কিন্তু এ যে বড় শক্ত কথা । কারাদণ্ডে দণ্ডিত যে গোরার প্রতি বিনয়ের প্রেম আরও যেন দ্বিগুণ বেগে ধাবিত হইতেছে তাহার জন্ত সে এত বড়ো একটা আঘাত প্রস্তুত করিয়া রাথিতে পারে কি ? তা ছাড়া সংস্কার । সমাজকে বুদ্ধিতে লঙ্ঘন করা সহজ— কিন্তু কাজে লঙ্ঘন করিবার বেলায় ছোটোবড়ে কত জায়গায় টান পড়ে। একটা অপরিচিতের আতঙ্ক, একটা অনভ্যস্তের প্রত্যাখ্যান বিনা যুক্তিতে কেবলই পিছনের দিকে ঠেলিতে থাকে । বিনয় কহিল, “মা, তোমাকে যতই দেখছি আশ্চর্ষ হয়ে যাচ্ছি। তোমার মন একেবারে এমন সাফ হল কী করে ! তোমাকে কি পায়ে চলতে হয় না— ঈশ্বর তোমাকে কি পাখ দিয়েছেন ? তোমার কোনো জায়গায় কিছু ঠেকে না ?” আনন্দময়ী হাসিয়া কছিলেন, “ঈশ্বর আমার ঠেকবার মতো কিছুই রাখেন নি । সমস্ত একেবারে পরিষ্কার করে দিয়েছেন ।” বিনয় কহিল, "কিন্তু, মা, আমি মুখে যাই বলি মনটাতে ঠেকে যে এত যে বুঝিমুঝি, পড়ি শুনি, তর্ক করি, হঠাৎ দেখতে পাই মনটা নিতান্ত মূখই রয়ে গেছে।” এমন সময় মহিম ঘরে ঢুকিয়াই বিনয়কে ললিতা সম্বন্ধে এমন নিতাস্ত রূঢ় রকম করিয়া প্রশ্ন করিলেন যে, তাহার হৃদয় সংকোচে পীড়িত হইয়া উঠিল । সে আত্মজমন করিয়া মুখ নিচু করিয়া নিরুত্তরে বলিয়া রহিল । তখন মহিম সকল পক্ষের প্রতি তীক্ষ খোচা দিয়া নিতান্ত অপমানকর কথা কতকগুলা বলিয়া চলিয়া গেলেন। তিনি