পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৪৩৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8૨૭ রবীন্দ্র-রচনাবলী হিন্দুধর্ম যে আজও কিরূপ সজীব আছে তাহা গৌরমোহনবাবুর এই প্রায়শ্চিত্তের নিমন্ত্রণে প্রচার হইবে । প্রায়শ্চিত্তসভা কবে কোথায় আহত হইবে সে প্রশ্নও উঠিল । গোরা কহিল, এ বাড়িতে সুবিধা হইবে না। একজন ভক্ত তাহার গঙ্গার ধারের বাগানে এই ক্রিয়া সম্পন্ন করার প্রস্তাব করিল। ইহার খরচও দলের লোকে সকলে মিলিয়া বহন করিবে স্থির হইয়া গেল । বিদায়গ্রহণের সময় অবিনাশ উঠিয়া দাড়াইয়া বক্তৃতার ছাদে হাত নাড়িয়া সকলকে সম্বোধন করিয়া কহিল, "গৌরমোহনবাৰু বিরক্ত হতে পারেন— কিন্তু আজ আমার হৃদয় যখন পরিপূর্ণ হয়ে উঠেছে তখন এ কথা না বলেও আমি থাকতে পারছি নে, বেদ-উদ্ধারের জন্তে আমাদের এই পুণ্যভূমিতে অবতার জন্মগ্রহণ করেছিলেন, তেমনি হিন্দুধর্মকে উদ্ধার করবার জন্তেই আজ আমরা এই অবতারকে পেয়েছি । পৃথিবীতে কেবল আমাদের দেশেই ষড় ঋতু আছে, আমাদের এই দেশেই কালে কালে অবতার জন্মেছেন এবং আরও জন্মাবেন । আমরা ধন্য যে সেই সত্য আমাদের কাছে প্রমাণ হয়ে গেল । বলে ভাই, গৌরমোহনের জয় ।” অবিনাশের বাগিতায় বিচলিত হইয়া সকলে মিলিয়া গৌরমোচনের জয়ধ্বনি করিতে লাগিল । গোরা মর্মাস্তিক পীড়া পাইয় সেখান হইতে ছুটিয়া চলিয়া গেল । আজ জেলখান হইতে মুক্তির দিনে প্রবল একটা অবসাদ গোরার মনকে আক্রমণ করিল। নূতন উৎসাহে দেশের জন্ত কাজ করিবে বলিয়া গোরা জেলের অবরোধে অনেক দিন কল্পনা করিয়াছে । আজ সে নিজেকে কেবল এই প্রশ্ন করিতে লাগিল —‘হায়, আমার দেশ কোথায় ! দেশ কি কেবল আমার একলার কাছে ! আমার জীবনের সমস্ত সংকল্প যাহার সঙ্গে আলোচনা করিলাম সেই আমার আশৈশবের বন্ধু আজ এতদিন পরে কেবল একজন স্ত্রীলোককে বিবাহ করিবার উপলক্ষ্যে তাহার দেশের সমস্ত অতীত ও ভবিষ্যতের সঙ্গে এক মুহূর্তে এমন নির্মমভাবে পৃথক হইতে প্রস্তুত হইল । আর যাহাদিগকে সকলে আমার দলের লোক বলে, এতদিন তাহাদিগকে এত বুঝানোর পরও তাহারা আজ এই স্থির করিল যে, আমি কেবল হি দুয়ানি উদ্ধার করিবার জন্য অবতার হইয়া জন্মগ্রহণ করিয়াছি ! আমি কেবল মূর্তিমান শাস্কের বচন । আর, ভারতবর্ষ কোনোখানে স্থান পাইল না ! ষড় ঋতু! ভারতবর্ষে ষড় ঋতু আছে ! সেই বড় ঋতুর ষড়যন্ত্রে যদি অবিনাশের মতো এমন ফল ফলিয়া থাকে তবে দুই-চারিটা ঋতু কম থাকিলে ক্ষতি ছিল না।’