পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৪৪৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গোরা 翻 8ථථ গোরার সঙ্গে মুখে মুখে সমস্ত তর্ক চলিতে পারিত তাহা হইলে উত্তেজনা যেমন জাগিত তেমনি নিবুক্ত হইয়াও বাইত ; কিন্তু বিনয় দেখিল, এ বিষয়ে গোরা শেষ পর্যন্ত তর্ক করিবে না । ইহাতেও বিনয়ের মনে একটা উত্তাপ জাগিল ; লে ভাবিল— গোরা বুঝিবে না, বুঝাইবে না, কেবলই জোর করিবে । ‘জোর ! জোরের কাছে মাথা হেঁট করিতে পারিব না। বিনয় কহিল, ‘বাহাই ঘটুক আমি সত্যের পক্ষে । এই বলিয়া ‘সত্য বলিয়া একটি শব্দকে দুই হাতে সে বুকের মধ্যে স্বাকড়িয়া ধরিল। গোরার প্রতিকূলে একটি খুব প্রবল পক্ষকে দাড় করানো দরকার— এইজন্য, সত্যই যে বিনয়ের চরম অবলম্বন ইহাই সে বার বার করিয়া নিজের মনকে বলিতে লাগিল । এমন-কি, সত্যকেই সে যে আশ্রয় করিতে পারিয়াছে ইহাই মনে করিয়া নিজের প্রতি তাহার ভারি একটা শ্রদ্ধা জন্মিল । এইজন্ত বিনয় অপরাহ্লে স্বচরিতার বাড়ির দিকে যখন গেল তখন বেশ একটু মাথা তুলিয়া গেল । সত্যের দিকেই ঝুকিয়াছে বলিয় তাহার এত জোর, না, ঝোকটা আর-কিছুর দিকে সে কথা বিনয়ের বুঝিবার অবস্থা ছিল না । হরিমোহিনী তখন রন্ধনের উদযোগ করিতেছিলেন । বিনয় সেখানে রন্ধনশালার দ্বারে ব্রাহ্মণতনয়ের মধ্যাহ্নভোজনের দাবি মধুর করাইয়া উপরে চলিয়া গেল । স্বচরিতা একটা সেলাইয়ের কাজ লইয়া সেই দিকে চোথ নামাইয়া অঙ্গুলিচালনা করিতে করিতে আলোচ্য কথাটা পাড়িল কহিল, “দেখুন বিনয়বাবু, ভিতরকার বাধা যেখানে নেই সেখানে বাইরের প্রতিকূলতাকে কি মেনে চলতে হবে ?” গোরার সঙ্গে যখন তর্ক হইয়াছিল তখন বিনয় বিরুদ্ধ যুক্তি প্রয়োগ করিয়াছে। আবার স্বচরিতার সঙ্গে ধখন আলোচনা হইতে লাগিল তখনও সে উন্ট পক্ষের যুক্তি প্রয়োগ করিল। তখন গোরার সঙ্গে তাহার যে কোনো মতবিরোধ আছে এমন কথা কে মনে করিতে পারিবে ! বিনয় কহিল, "দিদি, বাইরের বাধাকে তোমরাও তো খাটো করে দেখছ না ।” স্বচরিতা কছিল, “তার কারণ আছে বিনয়বাৰু! আমাদের বাধাটা ঠিক বাইরের বাধা নয় । আমাদের সমাজ যে আমাদের ধর্মবিশ্বাসের উপরে প্রতিষ্ঠিত । কিন্তু আপনি ৰে সমাজে আছেন সেখানে আপনার বন্ধন কেবলমাত্র সামাজিক বন্ধন । এইজন্তে যদি ললিতাকে ব্রাহ্মসমাজ পরিত্যাগ করে যেতে হয় তার সেটাতে যত গুরুতর ক্ষতি, আপনার সমাজত্যাগে আপনার ততটা ক্ষতি নয় ।” ধর্ম মামুষের ব্যক্তিগত সাধনার জিনিস, তাহাকে কোনো সমাজের সঙ্গে জড়িত করা উচিত নহে এই বলিয়া বিনয় তর্ক করিতে লাগিল ।