পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৪৪৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গোরা 8ථI যে সেদিন বিনয় পরেশবাবুর কাছে শুনিয়াছিল ‘আমি স্বচরিতার কাছে শুনিয়াছি ললিতার মন তোমার প্রতি বিমুখ নহে, এই কথাটিকে সে নানাভাবে নানারূপে নানাপ্রকার ছবির মতো করিয়া দেখিতে পাইল । একটা অনির্বচনীয় আবেগ বিনয়ের মনের মধ্যে অত্যন্ত করুণ উদাস রাগিণীর মতো বাজিতে লাগিল । যে-সব জিনিসকে এমনতরো নিবিড় গভীররূপে মনের গোপনতার মধ্যে ভাষাহীন আভাসের মতো পাওয়া যায় তাহাদিগকে কোনোমতে প্রত্যক্ষ করিয়া তুলিবার ক্ষমতা নাই বলিয়া, অর্থাং বিনয় কবি নয়, চিত্রকর নয় বলিয়া, তাহার সমস্ত অস্ত:করণ চঞ্চল হইয়া উঠিল । সে যেন কী-একটা করিতে পরিলে বাচে, অথচ সেটা করিবার কোনো উপায় নাই, এমনি তাহার মনে হইতে লাগিল । যে-একটা পর্দ। তাহার সম্মুখে ঝুলিতেছে, যাহা অতি নিকটে তাহাকে নিরতিশয় দূর করিয়া রাথিয়াছে, সেই পর্দাটাকে কি এই মুহূর্তে উঠিয় দাড়াইয়া জোর করিয়া ছিড়িয়া ফেলিবার শক্তি বিনয়ের নাই ! হরিমোহিনী ঘরে প্রবেশ করিয়া জিজ্ঞাস করিলেন, বিনয়, এখন কিছু জল খাইবে কি না । বিনয় কহিল, "না ।” তখন হরিমোহিনী আসিয়া ঘরে বসিলেন । হরিমোহিনী যতদিন পরেশবাবুর বাড়িতে ছিলেন ততদিন বিনয়ের প্রতি র্তাহার খুব একট আকর্ষণ ছিল । কিন্তু যখন হইতে স্বচরিতাকে লইয়া তাহার স্বতন্ত্র ঘরকন্না হইয়াছে তপন হইতে ইহাদের যাতায়াত তাহার কাছে অত্যন্ত অরুচিকর হইয়া উঠিয়ছিল । আজকাল আচারে বিচারে স্বচরিত যে সম্পূর্ণ র্তাহাকে মানিয়া চলে না এই-সকল লোকের সঙ্গদোষকেই তিনি তাহার কারণ বলিয়া ঠিক করিয়াছিলেন । যদিও তিনি জানিতেন বিনয় ব্রাহ্ম নহে, তবু বিনয়ের মনের মধ্যে যে কোনো হিন্দু সংস্কারের দৃঢ়তা নাই তাহ তিনি স্পষ্ট অনুভব করিতেন । তাই এখন তিনি পূর্বের ন্যায় উৎসাহের সহিত এই ব্রাহ্মণতনয়কে ডাকিয়া লইয়া ঠাকুরের প্রসাদের অপব্যয় করিতেন न | আজ প্রসঙ্গক্রমে হরিমোহিনী বিনয়কে জিজ্ঞাসা করিলেন, “আচ্ছা বাবা, তুমি তে ব্রাহ্মণের ছেলে, কিন্তু সন্ধ্যা-অৰ্চনা কিছুই কর না ?” বিনয় কহিল, "মাসি, দিনরাত্রি পড়া মুখস্থ করে করে গায়ত্রী সন্ধ্যা সমস্তই ভুলে গেছি।” হরিমোহিনী কহিলেন, “পরেশবাবুও তো লেখাপড়া শিখেছেন । উনি তো নিজের ধর্ম মেনে সকালে সন্ধ্যায় একটা-কিছু করেন ।” বিনয় কহিল, "মালি, উনি যা করেন তা কেবল মন্ত্র মুখস্থ করে করা যায় না। ওঁর মতো যদি কখনো হই তবে ওঁর মতো চলব ।”