পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৪৪৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গোরা 8oግ হইতে বিনয়ের প্রতিও তাহার মনোভাবের একটা পরিবর্তন ঘটিয়াছে। কয়েক দিন পূর্বেও, বিনয়ের প্রতি যে তাহার একটা জোর দখল আছে এ কথা সে খুব স্পর্ধা করিয়াই মনে করিয়াছিল। কিন্তু গোরার প্রভাবকে বিনয় কোনোমতেই কাটাইয়া উঠিতে পারিবে না, ইহা কল্পনামাত্র করিয়াই সে বিনয়ের বিরুদ্ধে কোমর বাধিয়া দাড়াইল । ললিতাকে ঘরে প্রবেশ করিতে দেখিবামাত্র বিনয়ের মনের মধ্যে একটা আন্দোলন প্রবল হইয়া উঠিল। ললিতা সম্বন্ধে বিনয় কোনোমতেই সহজ ভাব রক্ষা করিতে পারে না যখন হইতে তাহাদের দুই জনের বিবাহ-সস্তাবনার জনশ্রুতি সমাজে রটিয়া গেছে তখন হইতে ললিতাকে দেখিবামাত্র বিনয়ের মন বৈদ্যুতচঞ্চল চুম্বকশলার মতো স্পন্দিত হইতে থাকে । ঘরে বিনয়কে বসিয়া থাকিতে দেখিয়া স্বচরিতার প্রতি ললিতার রাগ হইল । সে বুঝিল, অনিচ্ছুক বিনয়ের মনকে অমুকুল করিবার জন্যই স্বচরিতা তাহাকে লইয়া উঠিয়া পড়িয়া লাগিয়াছে এবং এই বঁাকাকে সোজা করিবার জন্যই ললিতাকে আজ ডাক পড়িয়াছে । সে হরিমোহিনীর দিকে চাহিয়া কছিল, "দিদিকে বোলো, এখন আমি থাকতে পারছি নে । আর-এক সময় আমি আসব ।” এই বলিয়া বিনয়ের প্রতি কটাক্ষপাত মাত্র না করিয়া দ্রুতবেগে সে চলিয় গেল । তখন বিনয়ের কাছে হরিমোহিনীর আর বসিয়া থাকা অনাবশ্যক হওয়াতে তিনিও গৃহকার্য উপলক্ষ্যে উঠিয়া গেলেন। ললিতার এই চাপা আগুনের মতো মুখের ভাব বিনয়ের কাছে অপরিচিত ছিল না। কিন্তু অনেক-দিন এমন চেহারা সে দেখে নাই । সেই-যে এক সময়ে বিনয়ের সম্বন্ধে ললিতা তাহার অগ্নিবাণ উদ্যত করিয়াই ছিল, সেই দুর্দিন একেবারে কাটিয়া গিয়াছে বলিয়াই বিনয় নিশ্চিস্ত হইয়াছিল, আজ দেখিল সেই পুরাতন বাণ অস্থশালা হইতে আবার বাহির হইয়াছে । তাহাতে একটুও মরিচার চিহ্ন পড়ে নাই । রাগ সহ করা যায়, কিন্তু ঘৃণা সহ করা বিনয়ের মতো লোকের পক্ষে বড়ো কঠিন । ললিতা এক দিন তাহাকে গোরাগ্রহের উপগ্রহমাত্র মনে করিয়া তাহার প্রতি কিরূপ তীব্র অবজ্ঞা অনুভব করিয়াছিল তাহা বিনয়ের মনে পড়িল । আজও বিনয়ের দ্বিধায় বিনয় ললিতার কাছে যে কাপুরুষ বলিয়া প্রতীয়মান হইতেছে, এই কল্পনায় তাহাকে অস্থির করিয়া তুলিল। তাহার কর্তবাবুদ্ধির সংকোচকে ললিতা ভীরুতা বলিয়া মনে করিবে, অথচ এ সম্বন্ধে নিজের হইয়া দুটো কথা বলিবারও স্বযোগ তাহার ঘটবে না,