পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৪৬১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গোরা 88వి এমন-কি আনন্দময়ীর কাছে যাওয়াও তাহার পক্ষে অসম্ভব হইল । রাস্তায় ঘুরিয়া বেড়াইবার মতো শক্তিও তাহার ছিল না । তাই সে আপনার জনহীন বাসার মধ্যে গিয়া উপরের ঘরে তক্তপোশের উপর শুইয়া পড়িল । সন্ধ্যা হইয়া আসিয়াছে । অন্ধকার ঘরে চাকর বাতি আনিতেই তাহাকে বারণ করিবে মনে করিতেছে, এমন সময়ে বিনয় নীচে হইতে আহবান শুনিল, “বিনয়বাৰু! বিনয়বাবু!” বিনয় যেন বাচিয়া গেল। সে যেন মরুভূমিতে তৃষ্ণার জল পাইল । এই মুহূর্তে একমাত্র সতীশ ছাড়া আর কেহই তাহাকে আরাম দিতে পারিত না । বিনয়ের নিজীবতা চুটিয়া গেল। "কী ভাই সতীশ” বলিয়া সে বিছানা হইতে লাফাইয়া উঠিয়া জুতা পায়ে না দিয়াই দ্রুতপদে সিঁড়ি দিয়া নীচে নামিয়া গেল । দেখিল, তাহার ছোটো উঠানটিতে সিঁড়ির সামনেই সতীশের সঙ্গে বরদাসুন্দরী দাড়াইয়া আছেন। আবার সেই সমস্তা, সেই লড়াই ! শশব্যস্ত হইয়া বিনয় সতীশ ও বরদাসুন্দরীকে উপরের ঘরে লইয়া গেল । বরদাসুন্দরী সতীশকে কহিলেন, “সতীশ, যা তুই ওই বারান্দায় গিয়ে একটু বোস গে যা ।” সতীশের এই নিরানন্দ নির্বাসনদণ্ডে ব্যথিত হইয়া বিনয় তাহাকে কতকগুলা ছবির বই বাহির করিয়া দিয়া পাশের ঘরে আলো জালিয়া বসাইয়া দিল । বরদাসুন্দরী যখন বলিলেন "বিনয়, তুমি তো ব্রাহ্মসমাজের কাউকে জান না— আমার হাতে একখানা চিঠি লিখে দাও, আমি কাল সকালেই নিজে গিয়ে সম্পাদকমহাশয়কে দিয়ে সমস্ত বন্দোবস্ত করে দেব, যাতে পরশু রবিবারেই তোমার দীক্ষা হয়ে যায়। তোমাকে আর কিছুই ভাবতে হবে না”— তখন বিনয় কোনো কথাই বলিতে পারিল না। সে র্তাহার আদেশ অনুসারে একখানি চিঠি লিখিয়া বরদাসুন্দরীর হাতে দিয়া দিল । যাহা হউক, একটা কোনো পথে এমন করিয়া বাহির হইয়া পড়া তাহার দরকার হইয়াছিল ষে, ফিরিবার বা দ্বিধা করিবার কোনো উপায়মাত্র না থাকে। ললিতার সঙ্গে বিবাহের কথাটাও বরদাসুন্দরী একটুখানি পাড়িয়া রাখিলেন। বরদাস্বন্দরী চলিয়া গেলে বিনয়ের মনে ভারি একটা যেন বিতৃষ্ণ বোধ হইতে লাগিল। এমন-কি, ললিতার স্থতিও তাছার মনের মধ্যে কেমন একটু বেম্বরে বাজিতে লাগিল। তাহার মনে হইতে লাগিল যেন বরদাস্বন্দরীর এই অশোভন ব্যস্ততার সঙ্গে ললিতারও একটা কোথাও যোগ আছে। নিজের প্রতি শ্রদ্ধাহ্রাসের সঙ্গে সঙ্গে সকলেরই প্রতি তাহার শ্রদ্ধা যেন নামিয়া পড়িতে লাগিল । বরদাসুন্দরী বাড়ি ফিরিয়া আসিয়াই মনে করিলেন, ললিতাকে তিনি আজ খুশি