পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৪৬৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

86.8 রবীন্দ্র-রচনাবলী স্বচরিতা কহিল, “আমি যাকে ধর্ম বলে জ্ঞান করছি হিন্দু যদি তাকে আঘাত বলে গণ্য করে, তবে সে স্থলে আমাকে আপনি কী করতে বলেন ?” গোরা কহিল, “তখন আমি আপনাকে বলব যে, যেটাকে আপনি কর্তব্য মনে করছেন সেটা যখন হিন্দুজাতি ব'লে এতবড়ো একটি বিরাট সত্তার পক্ষে বেদনাকর আঘাত তখন আপনাকে খুব চিন্তা করে দেখতে হবে আপনার মধ্যে কোনো ভ্রম, কোনো অন্ধতা আছে কিনা— আপনি সব দিক সকল রকম করে চিন্তা করে দেখেছেন কিনা ৷ দলের লোকের সংস্কারকে কেবলমাত্র অভ্যাস বা আলস্ত -বশত সত্য বলে ধরে নিয়ে এতবড়ো একটা উৎপাত করতে প্রবৃত্ত হওয়া ঠিক নয়। ইদুর যখন জাহাজের খোল কাটতে থাকে তখন ইদুরের সুবিধা ও প্রবৃত্তির হিসাব থেকেই সে কাজ করে, দেখে না এতবড়ে একটা আশ্রয়ে ছিদ্র করলে তার যেটুকু স্ববিধা তার চেয়ে সকলের কতবড়ো ক্ষতি | আপনাকেও তেমনি ভেবে দেখতে হবে আপনি কি কেবল আপনার দলটির কথা ভাবছেন, না সমস্ত মামুষের কথা ভাবছেন ? সমস্ত মানুষ বললে কতটা বোঝায় তা জানেন ? তার কত রকমের প্রকৃতি, কতরকমের প্রবৃত্তি, কত রকমের প্রয়োজন ? সব মানুষ এক পথে এক জায়গায় দাড়িয়ে নেই— কারও সামনে পাহাড়, কারও সামনে সমুদ্র, কারও সামনে প্রাস্তর। অথচ কারও বসে থাকবার জো নেই, সকলকেই চলতে হবে । আপনি কেবল আপনার দলের শাসনটিকেই সকলের উপর থাটাতে চান ? চোখ বুজে মনে করতে চান মানুষের মধ্যে কোনো বৈচিত্র্যই নেই, কেবল ব্রাহ্মসমাজের খাতায় নাম লেখাবার জন্যেই সকলে পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করেছে ? যে-সকল দস্থ্যজাতি পৃথিবীর সমস্ত জাতিকেই যুদ্ধে জয় করে নিজের একচ্ছত্র রাজত্ব বিস্তার করাকেই পৃথিবীর একমাত্র কল্যাণ ব’লে কল্পনা করে, অন্যান্য জাতির বিশেষত্ব যে বিশ্বহিতের পক্ষে বহুমূল্য বিধান নিজের বলগর্বে তা যারা স্বীকার করে না এবং পৃথিবীতে কেবল দাসত্ব বিস্তার করে, তাদের সঙ্গে আপনাদের প্রভেদ কোনখানে ?” স্বচরিতা ক্ষণকালের জন্য তর্কযুক্তি সমস্তই ভুলিয়া গেল । গোরার বজ্ৰগম্ভীর কণ্ঠস্বর একটি আশ্চর্য প্রবলতাদ্বারা তাহার সমস্ত অন্তঃকরণকে আন্দোলিত করিয়া তুলিল । গোরা যে কোনো-একটা বিষয় লইয়া তর্ক করিতেছে তাহা স্বচরিতার মনে রছিল না, তাহার কাছে কেবল এই সত্যটুকুই জাগিতে লাগিল যে, গোরা বলিতেছে। গোরা কহিল, “আপনাদের সমাজই ভারতের বিশ কোটি লোককে স্বষ্টি করে নি ; কোন পন্থ। এই বিশ কোটি লোকের পক্ষে উপযোগী, কোন বিশ্বাস কোন আচার এদের সকলকে খাদ্য দেবে, শক্তি দেবে, তা বেঁধে দেবার ভার জোর করে নিজের উপর নিয়ে