পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৪৭৩

গোরা 8Sり> বটে, কিন্তু ঘনিষ্ঠতার স্থলে এরূপ রূঢ় ব্যবহার চলিতে পারে মনে করিয়া গোরা সেটাকে আত্মীয়ভার লক্ষণ বলিয়াই স্থির করিয়াছিল । তাহার পরে টেবিলের উপর এই চিঠিখানা দেখিয়া গোরা খুব একটা ধাক্কা পাইল । চিঠি বড়ো একটা রহস্যময় পদার্থ। বাহিরে কেবল নামটুকু দেখাইয়া সব কথাই সে ভিতরে রাখিয় দেয় বলিয়া সে মানুষকে নিতান্ত অকারণে নাকাল করিতে পারে । গোরা স্বচরিতার মুখের দিকে চাহিয়া কহিল, “আমি কাল আগব ।” স্বচরিতা আনতনেত্ৰে কহিল, "আচ্ছা ।” গোরা বিদায় লইতে উন্মুখ হইয়া হঠাৎ থামিয়া দাড়াইয়া বলিয়া উঠিল, “ভারতবর্ষের সৌরমণ্ডলের মধ্যেই তোমার স্থান— তুমি আমার আপন দেশের— কোনো ধূমকেতু এসে তোমাকে যে তার পুচ্ছ দিয়ে বেঁটিয়ে নিয়ে শূন্তের মধ্যে চলে যাবে সে কোনোমতেই হতে পারবে না । যেখানে তোমার প্রতিষ্ঠা সেইখানেই তোমাকে দৃঢ় করে প্রতিষ্ঠিত করব তবে আমি ছাড়ব । সে জায়গায় তোমার সত্য, তোমার ধর্ম, তোমাকে পরিত্যাগ করবে এই কথা এর তোমাকে বুঝিয়েছে— আমি তোমাকে স্পষ্ট করে জানিয়ে দেব তোমার সত্য— তোমার ধর্ম— কেবল তোমার কিম্বা আর দু-চার জনের মত বা বাক্য নয় ; সে চারি দিকের সঙ্গে অসংখ্য প্রাণের সূত্রে জড়িত— তাকে ইচ্ছা করলেই বন থেকে উপড়ে নিয়ে টবের মধ্যে পোতা যায় না— যদি তাকে উজ্জল ক’রে সজীব ক’রে রাখতে চাও, যদি তাকে সর্বাঙ্গীণরূপে সার্থক করে তুলতে চাও, তবে তোমার জন্মের বহু পূর্বে যে লোকসমাজের হৃদয়ের মধ্যে তোমার স্থান নির্দিষ্ট হয়ে গেছে সেইখানে তোমাকে আসন নিতেই হবে— কোনো মতেই বলতে পারবে না, আমি ওর পর, ও আমার কেউ নয় ! এ কথা যদি বল তবে তোমার সত্য, তোমার ধর্ম, তোমার শক্তি একেবারে ছায়ার মতো স্নান হয়ে যাবে। ভগবান তোমাকে যে জায়গায় পাঠিয়ে দিয়েছেন সে জায়গা যেমনি হোক তোমার মত যদি সেখান থেকে তোমাকে টেনে সরিয়ে নিয়ে যায় তবে তাতে করে কখনোই তোমার মতের জয় হবে না, এই কথাটা আমি তোমাকে নিশ্চয় বুঝিয়ে দেব। আমি কাল আসব।” এই বলিয়া গোর। চলিয়া গেল। ঘরের ভিতরকার বাতাস যেন অনেক ক্ষণ ধরিয়া কঁাপিতে লাগিল। স্বচরিতা মূর্তির মতো নিস্তব্ধ হইয়া বলিয়া রহিল। ©br বিনয় আনন্দময়ীকে কহিল, “দেখো মা, আমি তোমাকে সত্য বলছি, যতবার আমি ঠাকুরকে প্রণাম করেছি আমার মনের ভিতরে কেমন লজ্জা বোধ হয়েছে।