পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৪৭৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

৪৬২ রবীন্দ্র-রচনাবলী সে লজ্জা আমি চেপে দিয়েছি— উলটে আরও ঠাকুরপূজার পক্ষ নিয়ে ভালো ভালো প্রবন্ধ লিখেছি । কিন্তু সত্য তোমাকে বলছি, আমি যখন প্রণাম করেছি আমার মনের ভিতরটা তখন সায় দেয় নি ।” আনন্দময়ী কহিলেন, “তোর মন কি সহজ মন! তুই তো মোটামুটি করে কিছুই দেখতে পারিস নে। সব তাতেই একটা-কিছু সূক্ষ্ম কথা ভাবিস । সেই জন্যেই তোর মন থেকে থুংমুং আর ঘোচে না ।” বিনয় কছিল, “ওই কথাই তো ঠিক । অধিক স্বহ্ম বুদ্ধি বলেই আমি যা বিশ্বাস না করি তাও চুল-চেরা যুক্তির দ্বারা প্রমাণ করতে পারি। স্থবিধামত নিজেকে এবং অন্তকে ভোলাই। এতদিন আমি ধৰ্মসম্বন্ধে যে-সমস্ত তর্ক করেছি সে ধর্মের দিক থেকে করি নি, দলের দিক থেকে করেছি।” আনন্দময়ী কহিলেন, "ধর্মের দিকে যখন সত্যকার টান না থাকে তখন ওইরকমই ঘটে । তখন ধর্মটাও বংশ মান টাকাকড়ির মতোই অহংকার করবার সামগ্রী হয়ে দাড়ায় ।” বিনয় । হা, তখন এটা যে ধর্ম সে কথা ভাবি নে, এটা আমাদের ধর্ম এই কথা মনে নিয়েই যুদ্ধ করে বেড়াই। আমিও এতকাল তাই করেছি। তবুও আমি নিজেকে যে নিঃশেষে ভোলাতে পেরেছি তা নয় ; যেখানে আমার বিশ্বাস পেচচ্ছে না সেখানে আমি ভক্তির ভান করছি বলে বরাবর আমি নিজের কাছে নিজে লজ্জিত হয়েছি । আনন্দময়ী কহিলেন, “সে কি আর আমি বুঝি নে । তোরা যে সাধারণ লোকের চেয়ে ঢের বেশি বাড়াবাড়ি করিস তার থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়, মনের ভিতরটাতে ফাক আছে বলে সেইটে বোজাতে তোদের অনেক মসলা খরচ করতে হয় । ভক্তি সহজ হলে অত দরকার করে না ।” বিনয় কহিল, "তাই তো আমি তোমাকে জিজ্ঞাসা করতে এসেছি যা আমি বিশ্বাস করি নে তাকে বিশ্বাস করবার ভান করা কি ভালো ?” আনন্দময়ী কহিলেন, “শোনো একবার ! এমন কথাও জিজ্ঞাসা করতে হয় নাকি ?” বিনয় কহিল, “মা, আমি পরশু দিন ব্রাহ্মসমাজে দীক্ষা নেব।” আনন্দময়ী বিস্মিত হইয়া কহিলেন, “সেকি কথা বিনয় ? দীক্ষা নেবার কী এমন দরকার হয়েছে ?” বিনয় কহিল, "কী দরকার হয়েছে সেই কথাই তো এতক্ষণ বলছিলুম মা !” আনন্দময়ী কহিলেন, “তোর বা বিশ্বাস তা নিয়ে কি তুই আমাদের সমাজে থাকতে পারিস নে ?”