পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৪৭৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গোরা 8®(# তোমাদের সঙ্গে তার যোগ হতে পারবে না । লঙ্গ কোরো না মা, ঠিক করে বলে। দেখি এ কথাটা কি সত্য না ?” ললিতা আনন্দময়ীর মুখের দিকে মুখ তুলিয়াই কছিল, “মা, তোমার কাছে আমি কিছুই লজ্জা করব না— আমি তোমাকে বলছি, আমি এ-সব মানি নে। আমি খুব ভালো করেই ভেবে দেখেছি, মামুষের ধর্ম বিশ্বাস সমাজ যাই থাকৃ-না, সে-সমস্ত লোপ করে দিয়েই তবে মানুষের পরম্পরের সঙ্গে যোগ হবে এ কখনো হতেই পারে না। তা হলে তো হিন্দুতে খৃস্টানে বন্ধুত্বও হতে পারে না । তা হলে তো বড়ো বড়ো পাচিল তুলে দিয়ে এক-এক সম্প্রদায়কে এক-এক বেড়ার মধ্যেই রেখে দেওয়া উচিত।” আনন্দময়ী মুখ উজ্জল করিয়া কছিলেন, “আহ, তোমার কথা শুনে বড়ো আনন্দ হল । আমি তো ওই কথাই বলি । এক মান্বষের সঙ্গে আর-এক মানুষের রূপ গুণ স্বভাব কিছুই মেলে না, তবু তো সেজন্তে দুই মামুষের মিলনে বাধে না— আর মত বিশ্বাস নিয়েই বা বাধবে কেন ? মা, তুমি আমাকে বাচালে, আমি বিনয়ের জন্যে বড়ো ভাবছিলুম। ওর মন ও সমস্তই তোমাদের দিয়েছে সে আমি জানি– তোমাদের সঙ্গে সম্বন্ধে যদি ওর কোথাও কিছু ঘা লাগে সে তো বিনয় কোনোমতেই সইতে পারবে না। তাই ওকে বাধ দিতে আমার মনে যে কী রকম বাজছিল সে অস্তধামাই জানেন । কিন্তু, ওর কী সৌভাগ্য ! ওর এমন সংকট এমন সহজে কাটিয়ে দিলে, এ কি কম কথা ! একটা কথা জিজ্ঞাসা করি, পরেশবাবুর সঙ্গে কি এ কথা কিছু হয়েছে ?” ললিত লজ্জা চাপিয়া কহিল, "না, হয় নি । কিন্তু আমি জানি, তিনি সব কথা ঠিক বুঝবেন ।” আনন্দময়ী কহিলেন, "তাই যদি ন বুঝবেন তবে এমন বুদ্ধি এমন মনের জোর তুমি পেলে কোথা থেকে ? মা, আমি বিনয়কে ডেকে আনি, তার সঙ্গে নিজের মুখে তোমার বোঝাপড়া করে নেওয়া উচিত । এইবেলা আমি একটা কথা তোমাকে বলে নিই মা ! বিনম্বকে আমি এতটুকু বেলা থেকে দেখে আসছি— ও ছেলে এমন ছেলে বে, ওর জন্যে যত দুঃখই তোমরা স্বীকার করে নাও সে-সমস্ত দুঃথকেই ও সার্থক করবে এ আমি জোর করে বলছি । আমি কতদিন ভেবেছি বিনয়কে যে লাভ করবে এমন ভাগ্যবতী কে আছে । মাঝে মাঝে সম্বন্ধ এসেছে, কাউকে আমার পছন্দ হয় নি । আজ দেখতে পাচ্ছি ওরও ভাগ্য বড়ো কম নয় ।” এই বলিয়া আনন্দময়ী ললিতার চিবুক হইতে চুম্বন গ্রহণ করিয়া লইলেন ও বিনয়কে ভাকিয়া আনিলেন । কৌশলে লছমিয়াকে স্বরের মধ্যে বসাইয়া তিনি ললিতার আহারের আয়োজন উপলক্ষ্য করিয়া অঞ্চত্ৰ চলিয়া গেলেন ।