পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৪৮১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গোরা 8\ల) ভয় হয়, অসহ হয়ে পাছে হঠাৎ এমন কিছু করে ফেলি যাতে তুমিও কষ্ট পাও। তুমি এ কথা মনে কোরো না বাবা, আমি কিছুই ভাবি নি। আমি বেশ করে চিন্ত করে দেখেছি যে, আমার যে-রকম সংস্কার ও শিক্ষা তাতে ব্রাহ্মসমাজের বাইরে হয়তে আমাকে অনেক সংকোচ ও কষ্ট স্বীকার করতে হবে ; কিন্তু আমার মন কিছুমাত্র কুষ্ঠিত হচ্ছে না, বরঞ্চ মনের ভিতরে একটা জোর উঠছে, একটা আনন্দ হচ্ছে। আমার একটিমাত্র ভাবনা, বাবা, পাছে আমার কোনো কাজে তোমাকে কিছুমাত্র কষ্ট দেয় ।” এই বলিয়া ললিত আস্তে আস্তে পরেশবাবুর পায়ে হাত বুলাইতে লাগিল । পরেশবাবু ঈষং হাসিয়া কছিলেন, "মা, নিজের বুদ্ধির উপরেই যদি আমি একমাত্র নির্ভর করতুম তা হলে আমার ইচ্ছা ও মতের বিরোধে কোনো কাজ হলে দুঃখ পেতুম | তোমাদের মনে যে আবেগ উপস্থিত হয়েছে সেটা যে সম্পূর্ণ অমঙ্গল সে আমি জোর করে বলতে পারি নে। আমিও এক দিন বিদ্রোহ করে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এসেছিলুম, কোনো স্ববিধা-অসুবিধার কথা চিন্তাই করি নি। সমাজের উপর আজকাল এই-যে ক্রমাগত ঘাতপ্রতিঘাত চলছে এতে বোঝা যাচ্ছে তারই শক্তির কাজ চলছে । তিনি যে নানা দিক থেকে ভেঙে গ'ড়ে শোধন করে কোন জিনিসটাকে কী ভাবে দাড় করিয়ে তুলবেন আমি তার কী জানি! ব্রাহ্মসমাজই কি আর হিন্দুসমাজই কি, তিনি দেখছেন মানুষকে ।” এই বলিয়া পরেশবাবু মুহূর্তকালের জন্য চোখ বুজিয়া নিজের অস্তঃকরণের নিভৃতের মধ্যে নিজেকে যেন স্থির করিয়া লইলেন । কিছুক্ষণ স্তন্ধ থাকিয়। পরেশবাবু কছিলেন, “দেখে বিনয়, ধর্মমতের সঙ্গে আমাদের দেশে সমাজ সম্পূর্ণ জড়িত হয়ে আছে, এইজন্তে আমাদের সমস্ত সামাজিক ক্রিয়াকর্মের সঙ্গে ধর্মাঙ্গুষ্ঠানের ষোগ আছে । ধর্মমতের গণ্ডির বাইরের লোককে সমাজের গণ্ডির মধ্যে কোনোমতে নেওয়া হবে না ব'লেই তার দ্বার রাখা হয় নি, সেটা তোমরা কেমন করে এড়াবে আমি তো ভেবে পাচ্ছি নে ৷” ললিতা কথাটা ভালো বুঝিতে পারিল না, কারণ অন্ত সমাজের প্রথার সহিত তাহাজের সমাজের প্রভেদ সে কোনোদিন প্রত্যক্ষ করে নাই । তাহার ধারণা ছিল, ষোটের উপর আচার-অনুষ্ঠানে পরম্পরে খুব বেশি পার্থক্য নাই। বিনয়ের সঙ্গে তাহাদের অনৈক্য যেমন অনুভবগোচর নয়, সমাজে সমাজেও যেন সেইরূপ । বস্তুত হিন্দুবিবাহ-অনুষ্ঠানের মধ্যে তাহার পক্ষে ষে বিশেষ কোনো বাধা আছে তাহলে জানিতই না । বিনয় কছিল, "শালগ্রাম রেখে আমাদের বিবাহ হয়, আপনি সেই কথা বলছেন ?”