পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৪৮৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8ԳՀ রবীন্দ্র-রচনাবলী গোরার আচরণে যখন সে এমন কিছু দেখে যাহার সঙ্গে তাহার ধর্মবিশ্বাসের মূলগত বিরোধ, তখন স্বচরিতার মন ভয়ে কঁাপিতে থাকে। ঈশ্বর এ কী লড়াইয়ের মধ্যে তাহাকে ফেলিয়াছেন । হরিমোহিনী নব্যমতাভিমানী স্বচরিতাকে স্বৰ্দষ্টান্ত দেখাইবার জন্য আজও গোরাকে র্তাহার ঠাকুরঘরে লইয়া গেলেন এবং আজও গোরা ঠাকুরকে প্রণাম করিল। স্বচরিতার বসিবার ঘরে গোরা নামিয়া আসিবামাত্রই স্বচরিতা তাহাকে জিজ্ঞাসা করিল, “আপনি কি এই ঠাকুরকে ভক্তি করেন ?” গোরা একটু যেন অস্বাভাবিক জোরের সঙ্গে কহিল, “হা, ভক্তি করি বৈকি।” শুনিয়া স্বচরিতা মাথা হেঁট করিয়া চুপ করিয়া বসিয়া রহিল। স্বচরিতার সেই নম্র নীরব বেদনায় গোরা মনের মধ্যে একটা আঘাত পাইল । সে তাড়াতাড়ি কহিল, “দেখে, আমি তোমাকে সত্য কথা বলব। আমি ঠাকুরকে ভক্তি করি কিনা ঠিক বলতে পারি নে, কিন্তু আমি আমার দেশের ভক্তিকে ভক্তি করি। এতকাল ধরে সমস্ত দেশের পূজা যেখানে পৌচেছে আমার কাছে সে পূজনীয়। আমি কোনোমতেই খৃস্টান মিশনারির মতো সেখানে বিষদৃষ্টিপাত করতে পারি নে ৷” স্বচরিতা মনে মনে কী চিন্তা করিতে করিতে গোরার মুখের দিকে চাহিয়া রহিল। গোরা কহিল, “আমার কথা ঠিকমতে বোঝা তোমার পক্ষে খুব কঠিন সে আমি জানি। কেননা, সম্প্রদায়ের ভিতরে মাহুষ হয়ে এ-সব জিনিসের প্রতি সহজ দৃষ্টিপাত করবার শক্তি তোমাদের চলে গিয়েছে। তুমি যখন তোমার মাসির ঘরে ঠাকুরকে দেখ তুমি কেবল পাথরকেই দেখ, আমি তোমার মাসির ভক্তিপূর্ণ করুণ হৃদয়কেই দেখি। সে দেখে আমি কি আর রাগ করতে পারি, অবজ্ঞা করতে পারি! তুমি কি মনে কর ওই হৃদয়ের দেবতা পাথরের দেবতা ।” স্বচরিতা কহিল, "ভক্তি কি করলেই হল ? কাকে ভক্তি করছি কিছুই বিচার করতে হবে না ?” গোরা মনের মধ্যে একটু উত্তেজিত হইয়া কহিল, "অর্থাৎ, তুমি মনে করছ একটা সীমাবদ্ধ পদার্থকে ঈশ্বর বলে পূজা করা ভ্ৰম । কিন্তু কেবল দেশকালের দিক থেকেই কি সীমা নির্ণয় করতে হবে ? মনে করে ঈশ্বরের সম্বন্ধে কোনো একটি শাস্কের বাক্য স্মরণ করলে তোমার খুব ভক্তি হয় ; সেই বাক্যটি যে পাতায় লেখা আছে সেই পাতাটা মেপে, তার অক্ষর কয়টা গুনেই কি তুমি সেই বাক্যের মহত্ব স্থির করবে ? ভাবের অসীমতা বিস্তৃতির অসীমতার চেয়ে যে ঢের বড়ো জিনিস । চন্দ্ৰস্থৰ্যতারাখচিত অনন্ত আকাশের চেয়ে ওই এতটুকু ঠাকুরটি যে তোমার মাসির কাছে ৰথার্থ অসীম।