পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৪৮৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গোর 8ፃ¢ স্বচরিতার সেই সংকোচবিহীন সংশয়বিহীন অশ্রদ্ধারাশ্লাবিত দুই চক্ষুর সম্মুখে, ভূমিকম্পে পাথরের রাজপ্রাসাদ যেমন টলে তেমনি করিয়া গোরার সমস্ত প্রকৃতি যেন টলিতে লাগিল । গোর প্রাণপণ বলে আপনাকে সম্বরণ করিয়া লইবার জন্ত মুখ ফিরাইয়া জানালার বাহিরের দিকে চাহিল । তখন সন্ধ্যা হইয়া গিয়াছে । গলির রেখা সংকীর্ণ হইয়া যেখানে বড়ো রাস্তায় পড়িয়াছে সেখানে খোলা আকাশে কালো পাথরের মতো অন্ধকারের উপর তারা দেখা যাইতেছে । সেই আকাশখগু, সেই ক’টি তারা গোরার মনকে আজ কোথায় বহন করিয়া লইয়া গেল– সংসারের সমস্ত দাবি হইতে, এই অভ্যস্ত পৃথিবীর প্রতিদিনের স্বনির্দিষ্ট কর্মপদ্ধতি হইতে কত দূরে! রাজ্যসাম্রাজ্যের কত উত্থানপতন, যুগযুগান্তরের কত প্রয়াস ও প্রার্থনাকে বহুদূরে অতিক্রম করিয়া ওইটুকু আকাশ এবং ওই ক’টি তারা সম্পূর্ণ নির্লিপ্ত হইয়া অপেক্ষ করিয়া আছে ; অথচ, অ তলস্পর্শ গভীরতার মধ্য হইতে এক হৃদয় যখন আর-এক হৃদয়কে আহবান করে তখন নিভৃত জগৎপ্রাস্তের সেই বাক্যহীন ব্যাকুলত যেন ওই দূর আকাশ এবং দূর তারাকে স্পদিত করিতে থাকে। কর্মরত কলিকাতার পথে গাড়িঘোড়া ও পথিকের চলাচল এই মুহূর্তে গোরার চক্ষে ছায়াছবির মতে বস্তুহীন হইয়া গেল— নগরের কোলাহল কিছুই তাহার কাছে আর পৌছিল না । নিজের হৃদয়ের দিকে চাহিয়া দেখিল— সেও ওই আকাশের মতো নিস্তব্ধ, নিভৃত, অন্ধকার, এবং সেখানে জলে-ভরা দুইটি সরল সকরুণ চক্ষু নিমেষ হারাইয়া যেন অনাদিকাল হইতে অনন্তকালের দিকে তাকাইয়া আছে । হরিমোহিনীর কণ্ঠ শুনিয়া গোরা চমকিয়া উঠিয়া মুখ ফিরাইল । “বাবা, কিছু মিষ্টিমুখ করে যাও।” গোরা তাড়াতাড়ি বলিয়া উঠিল, “আজ কিন্তু নয়। আজ আমাকে মাপ করতে হবে— আমি এখনই যাচ্ছি।” বলিয়া গোরা আর-কোনো কথার অপেক্ষা না করিয়া দ্রুতবেগে বাহির হইয়া চলিয়া গেল । হরিমোহিনী বিস্থিত হইয়া স্বচরিতার মুখের দিকে চাছিলেন। স্বচরিতা ঘর হইতে বাহির হইয়া গেল । হরিমোহিনী মাথা নাড়িয়া ভাবিতে লাগিলেন— এ আবার কী কাও ! * অনতিকাল পরেই পরেশবাবু আসিয়া উপস্থিত হইলেন। স্বচরিতার ঘরে স্বচরিতাকে দেখিতে না পাইয়া হরিমোহিনীকে গিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “রাধারানী কোথায় ?”