পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৫০৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গোর। 8>> যে একই, মূর্তিপূজাতেই যে ভক্তিতত্বের একটি চরম পরিণতি নেই, এ কথা আমি নিতান্ত অভ্যস্ত বচনের মতো চোখ বুজে আওড়াতে পারব না। শিল্পে সাহিত্যে, এমনকি, বিজ্ঞানে ইতিহাসেও মানুষের কল্পনাবৃত্তির স্থান আছে, একমাত্র ধর্মের মধ্যে তার কোনো কাজ নেই এ কথা আমি স্বীকার করব না । ধর্মের মধ্যেই মামুষের সকল বৃত্তির চূড়ান্ত প্রকাশ । আমাদের দেশের মূর্তিপূজায় জ্ঞান ও ভক্তির সঙ্গে কল্পনার সম্মিলন হবার যে চেষ্টা হয়েছে সেটাতে করেই আমাদের দেশের ধর্ম কি মানুষের কাছে অন্য দেশের চেয়ে সম্পূর্ণতর সত্য হয়ে ওঠে নি ?” স্বচরিত কহিল, "গ্রীসে রোমেও তো মূর্তিপূজা ছিল ।” গোরা কহিল, “সেখানকার মূর্তিতে মানুষের কল্পনা সৌন্দর্যবোধকে যতটা আশ্রয় করেছিল জ্ঞানভক্তিকে ততটা নয় । আমাদের দেশে কল্পনা জ্ঞান ও ভক্তির সঙ্গে গভীররূপে জড়িত । আমাদের কৃষ্ণরাধাই বল, হরপার্বতীই বল, কেবলমাত্র ঐতিহাসিক পূজার বিষয় নয়, তার মধ্যে মানুষের চিরন্তন তত্ত্বজ্ঞানের রূপ রয়েছে। সেই জন্যই রামপ্রসাদের, চৈতন্যদেবের ভক্তি এই-সমস্ত মূর্তিকে অবলম্বন করে প্রকাশ পেয়েছে। ভক্তির এমন একfস্ত প্রকাশ গ্রীস-রোমের ইতিহাসে কবে দেখা দিয়েছে ?” স্বচরিত কহিল, "কালের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ধর্ম ও সমাজের কোনে পরিবর্তন আপনি একেবারে স্বীকার করতে চান না ?” গোরা কহিল, "কেন চাইব না ? কিন্তু পরিবর্তন তো পাগলামি হলে চলবে না । মানুষের পরিবর্তন মনুষ্যত্বের পথেই ঘটে— ছেলেমাহুষ ক্রমে বুড়োমানুষ হয়ে ওঠে, কিন্তু মানুষ তে হঠাৎ কুকুর-বিড়াল হয় না । ভারতবর্ষের পরিবর্তন ভারতবর্ষের পথেই হওয়া চাই, হঠাৎ ইংরাজি ইতিহাসের পথ ধরলে আগাগোড়া সমস্ত পণ্ড ও নিরর্থক হয়ে যাবে। দেশের শক্তি, দেশের ঐশ্বৰ্ষ, দেশের মধ্যেই সঞ্চিত হয়ে আছে সেইটে আমি তোমাদের জানাবার জন্যই আমার জীবন উৎসর্গ করেছি। আমার কথা বুঝতে পারছ ?” স্বচরিতা কছিল, “হা, বুঝতে পারছি। কিন্তু এসব কথা আমি কখনো পূর্বে শুনি নি এবং ভাবি নি। নতুন জায়গায় গিয়ে পড়লে খুব স্পষ্ট জিনিসেরও পরিচয় হতে যেমন বিলম্ব ঘটে আমার তেমনি হচ্ছে । বোধ হয় আমি স্ত্রীলোক ব’লেই আমার উপলব্ধিতে জোর পেচচ্ছে না।” h গোরা বলিয়া উঠিল, "কখনোই না। আমি তো অনেক পুরুষকে জানি, এই-সব আলাপ-আলোচনা আমি তাদের সঙ্গে অনেক দিন ধরে করে আসছি, তারা নিঃসংশয়ে ঠিক করে বলে আছে তারা খুব বুঝেছে ; কিন্তু আমি তোমাকে নিশ্চয় বলছি, তোমার