পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৫০৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গোরা 8వెల চৌকিতে বসিলেন। কিছুক্ষণ ঠোট চাপিয়া চুপ করিয়া থাকিয়া কহিলেন, “তুমি তো বাবা, ব্রাহ্ম নও ?” গোরা কছিল, “না ।” হরিমোহিনী কছিলেন, “আমাদের হিন্দুসমাজকে তুমি তো মান ?” গোরা কছিল, “মানি বইকি।” হরিমোহিনী কহিলেন, “তবে তোমার এ কী-রকম ব্যবহার ?” গোর হরিমোহিনীর অভিযোগ কিছুই বুঝিতে না পারিয়া চুপ করিয়া তাহার মুখের দিকে চাহিয়া রহিল । হরিমোহিনী কহিলেন, “রাধারানীর বয়স হয়েছে, তোমরা তো ওর আত্মীয় নও– ওর সঙ্গে তোমাদের এত কী কথা ! ও মেয়েমানুষ, ঘরের কাজকর্ম করবে, ওরই বা এ-সব কথায় থাকবার দরকার কী ? ওতে যে ওর মন অন্ত দিকে নিয়ে যায়। তুমি তো জ্ঞানী লোক, দেশ মৃদ্ধ সকলেই তোমার প্রশংসা করে, কিন্তু এ-সব আমাদের দেশে কবেই বা ছিল, আর কোন শাস্ত্রেই বা লেখে !” গোরা হঠাৎ একটা মস্ত ধাক্কা পাইল । স্বচরিতার সম্বন্ধে এমন কথা যে কোনো পক্ষ হইতে উঠিতে পারে তাহা সে চিন্তাও করে নাই। সে একটু চুপ করিয়া থাকিয়া কহিল, “ইনি ব্রাহ্মসমাজে আছেন, বরাবর এঁকে এই-রকম সকলের সঙ্গে মিশতে দেখেছি, সেইজন্যে আমার কিছু মনে হয় নি।” হরিমোহিনী কছিলেন, “আচ্ছা, ওই নাহয় ব্রাহ্মসমাজে আছে, কিন্তু তুমি তো এ-সব কখনো ভালো বল না । তোমার কথা শুনে আজিকালকার কত লোকের চৈতন্ত হচ্ছে, আর তোমার ব্যবহার এ-রকম হলে লোকে তোমাকে মানবে কেন ? এই-যে কাল রাত্রি পর্যন্ত ওর সঙ্গে তুমি কথা কয়ে গেলে, তাতেও তোমার কথা শেষ হল না— আবার আজ সকালেই এসেছ ! সকাল থেকে ও আজ না গেল ভাড়ারে, না গেল রান্নাঘরে, আজ একাদশীর দিনে আমাকে যে একটু সাহায্য করবে তাও ওর মনে হল না— এ ওর কী-রকম শিক্ষা হচ্ছে! তোমাদের নিজের ঘরেও তো মেয়ে আছে, তাদের নিয়ে কি সমস্ত কাজকর্ম বন্ধ করে তুমি এই-রকম শিক্ষা দিচ্ছ— না, জার-কেউ দিলে তুমি ভালো বোধ কর ” গোরার তরফে এ-সব কথার কোনো উত্তর ছিল না । সে কেবল কহিল, “ইনি এই-রকম শিক্ষাতেই মাছুষ হয়েছেন বলে আমি এর সম্বন্ধে কিছু বিবেচনা করি নি।” হরিমোহিনী কছিলেন, “ও ষে শিক্ষাই পেয়ে থাক যতদিন আমার কাছে আছে আর আমি বেঁচে আছি এ-সব চলবে না। ওকে আমি অনেকটা ফিরিয়ে এনেছি।