পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৫১৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গোরা ( পরেশবাবু গোরার এমন একটা জায়গায় ঘা দিলেন যেখানে তাহার মনে আপনিই একটা মন্থন চলিতেছিল এবং সেই মন্থন হইতে লে একটি সিদ্ধাস্তও লাভ করিয়াছিল, এইজন্যই তাহার অস্তরে সঞ্চিত বাক্যের বেগে পরেশবাবুর কাছেও তাহার কোনো কুণ্ঠ রহিল না । তাহার মোট কথাটা এই যে, নিয়মের দ্বারা আমরা নিজেকে যদি সমাজের সম্পূর্ণ বাধ্য না করি তবে সমাজের ভিতরকার গভীরতম উদ্দেশ্য কে বাধা দিই ; কারণ, সেই উদ্দেশ্য নিগৃঢ়, তাহাকে স্পষ্ট করিয়া দেখিবার সাধ্য প্রত্যেক লোকের নাই । এইজন্য বিচার না করিয়াও সমাজকে মানিয়া যাইবার শক্তি আমাদের থাক চাই । পরেশবাবু স্থির হইয়া শেষ পর্যন্ত গোরার সমস্ত কথাই শুনিলেন ; সে যখন থামিয়া গিয়া নিজের প্রগস্ভতায় মনের মধ্যে একটু লজ্জা বোধ করিল তখন পরেশ কহিলেন, “তোমার গোরার কথাটা আমি মানি ; এ কথা সত্য যে প্রত্যেক সমাজের মধ্যেই বিধাতার একটি বিশেষ অভিপ্রায় আছে। সেই অভিপ্রায় যে সকলের কাছে স্পষ্ট তাও নয় । কিন্তু তাকেই স্পষ্ট করে দেখবার চেষ্টা করাই তো মানুষের কাজ, গাছপালার মতো অচেতনভাবে নিয়ম মেনে যাওয়া তার সার্থকতা নয় ।” গোরা কহিল, "আমার কথাটা এই যে, আগে সমাজকে সব দিক থেকে সম্পূর্ণ মেনে চললে তবেই সমাজের যথার্থ উদ্দেশ্য সম্বন্ধে আমাদের চেতনা নির্মল হতে পারে। তার সঙ্গে বিরোধ করলে তাকে যে কেবল বাধা দিই তা নয়, তাকে ভুল বুঝি।” পরেশবাবু কহিলেন, “বিরোধ ও বাধা ছাড়া সত্যের পরীক্ষণ হতেই পারে না। সত্যের পরীক্ষা যে কোনো এক প্রাচীনকালে এক দল মনীষীর কাছে একবার হয়ে গিয়ে চিরকালের মতো চুকেবুকে যায় তা নয়, প্রত্যেক কালের লোকের কাছেই বাধার ভিতর দিয়ে, আঘাতের ভিতর দিয়ে, সত্যকে নূতন করে আবিষ্কৃত হতে হবে। যাই হোক, এ-সব কথা নিয়ে আমি তর্ক করতে চাই নে, আমি মানুষের ব্যক্তিগত স্বাধীনতাকে মানি । ব্যক্তির সেই স্বাধীনতার দ্বারা আঘাত করেই আমরা ঠিকমতো জানতে পারি কোনটা নিত্য সত্য আর কোনটা নশ্বর কল্পনা , সেইটে জানা এবং জানবার চেষ্টার উপরেই সমাজের হিত নির্ভর করছে।” এই বলিয়া পরেশ উঠিলেন, গোরাও চৌকি ছাড়িয়া উঠিল । পরেশ কহিলেন, “আমি ভেবেছিলুম ব্রাহ্মসমাজের অনুরোধে এই বিবাহ হতে আমাকে হয়তো একটুখানি সরে থাকতে হবে, তুমি বিনয়ের বন্ধু হয়ে সমস্ত কর্ম সম্পন্ন করে দেবে। এইখানেই আত্মীয়ের চেয়ে বন্ধুর একটু স্থবিধা আছে, সমাজের আঘাত তাকে সইতে