পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৫৪২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

(2○o রবীন্দ্র-রচনাবলী কাজকর্ম সমস্তই সমাজের নিমেষবিহীন চোখের উপরে দিনরাত্রি রহিয়াছে। প্রত্যেক লোকেরই লোকাচারের প্রতি অত্যন্ত একটি সহজ বিশ্বাস— সে সম্বন্ধে তাহীদের কোনো তর্কমাত্র নাই । কিন্তু সমাজের বন্ধনে, আচারে নিষ্ঠায়, ইহাদিগকে কর্মক্ষেত্রে কিছুমাত্র বল দিতেছে না । ইহাদের মতো এমন ভীত, অসহায়, আত্মহিতবিচারে অক্ষম জীব জগতে কোথাও আছে কিনা সন্দেহ । আচারকে পালন করিয়া চলা ছাড়া আর কোনো মঙ্গলকে ইহারা সম্পূর্ণ মনের সঙ্গে চেনেও না, বুঝাইলেও বুঝে না। দণ্ডের দ্বার, দলাদলির দ্বারা, নিষেধটাকেই তাহারা সব চেয়ে বড়ো করিয়া বুঝিয়াছে। কী করিতে নাই এই কথাটাই পদে পদে নানা শাসনের দ্বারা তাহাদের প্রকৃতিকে যেন আপাদমস্তক জালে বাধিয়াছে | কিন্তু এ জাল ঋণের জাল, এ বাধন মহাজনের বঁাধন— রাজার বাধন নহে । ইহার মধ্যে এমন কোনো বড়ো ঐক্য নাই যাহা সকলকে বিপদে সম্পদে পাশাপাশি দাড় করাইতে পারে । গোরা না দেখিয়া থাকিতে পারিল না যে, এই আচারের অস্বে মানুষ মানুষের রক্ত শোষণ করিয়া তাহীকে নিষ্ঠুরভাবে নি:স্বত্ব করিতেছে । কতবার সে দেখিয়াছে, সমাজে ক্রিয়াকর্মে কেহ কাহাকেও দয়ামাত্রও করে ন} । একজনের বাপ দীর্ঘকাল রোগে ভূগিতেছিল, সেই বাপের চিকিৎসা পথ্য প্রভৃতিতে বেচারা সর্বস্বাস্ত হইয়াছে, সে সম্বন্ধে কাহারও নিকট হইতে তাহার কোনে সাহায্য নাই— এ দিকে গ্রামের লোকে ধরিয়া পড়িল তাহার পিতাকে অজ্ঞাতপাতকজনিত চিরকুগণতার জন্য প্রায়শ্চিত্ত করিতে হইবে । সে হতভাগ্যের দারিদ্র্য অসামর্থ্য কাহারও অগোচর ছিল না, কিন্তু ক্ষমা নাই | সকলপ্রকার ক্রিয়াকর্মেই এইরূপ । যেমন ডাকাতির অপেক্ষ পুলিস-তদন্ত গ্রামের পক্ষে গুরুতর দুর্ঘটনা, তেমনি মা-বাপের মৃত্যুর অপেক্ষা মা-বাপের শ্রাদ্ধ সন্তানের পক্ষে গুরুতর দুর্ভাগ্যের কারণ হইয়া উঠে । অল্প আয় অল্প শক্তির দোহাই কেহই মানিবে না, যেমন করিয়া হউক সামাজিকতার হৃদয়হীন দাবি ষোলো আনা পূরণ করিতে হইবে । বিবাহ উপলক্ষ্যে কস্তার পিতার বোঝা যাহাতে দুঃসহ হইয়া উঠে এইজন্য বরের পক্ষে সর্বপ্রকার কৌশল অবলম্বন করা হয়, হতভাগ্যের প্রতি লেশমাত্র করুণা নাই । গোরা দেখিল এই সমাজ মানুষকে প্রয়োজনের সময় সাহায্য করে না, বিপদের সময় ভরসা দেয় না, কেবল শাসনের দ্বারা নতি স্বীকার করাইয়া বিপন্ন করে । শিক্ষিতসমাজের মধ্যে গোরা এ কথা তুলিয়াছিল । কারণ, সে সমাজে সাধারণের মঙ্গলের জন্য এক হইয়া দাড়াইবার শক্তি বাহির হইতে কাজ করিতেছে। এই সমাজে একত্রে মিলিবার নানাপ্রকার উদযোগ দেখা দিতেছে । এই-সকল মিলিত