পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৫৬৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গোর &8వ ইতিপূর্বে দেবপূজায় গোরা কোনোদিন মন দেয় নাই। যখন হইতে তাহার হৃদয় ক্ষুব্ধ হইয়া উঠিয়াছে, কিছুতেই সে আপনাকে বাধিয়া রাখিতে পারিতেছে না, কাজ তাহার কাছে শূন্ত বোধ হইতেছে এবং জীবনটা যেন আধখানা হইয়া কাদিয়া মরিতেছে, তখন হইতে গোরা পূজায় মন দিতে চেষ্টা করিতেছে। প্রতিমার সম্মুখে স্থির হইয়া বসিয়া সেই মূর্তির মধ্যে গোরা নিজের মনকে একেবারে নিবিষ্ট করিয়া দিতে চেষ্টা করে। কিন্তু কোনো উপায়েই সে আপনার ভক্তিকে জাগ্রত করিয়া তুলিতে পারে না। দেবতাকে সে বুদ্ধির দ্বারা ব্যাখ্যা করে, তাহাকে রূপক করিয়া না তুলিয়া কোনোমতেই গ্রহণ করিতে পারে না । কিন্তু রূপককে হৃদয়ের ভক্তি দেওয়া যায় না । আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যাকে পূজা করা যায় না । বরঞ্চ মন্দিরে বসিয়া পূজার চেষ্টা না করিয়া ঘরে বলিয়া নিজের মনে অথবা কাহারও সঙ্গে তর্কোপলক্ষে যখন ভাবের ম্রোতে মনকে ও বাক্যকে ভাসাইয়া দিত তখন তাহার মনের মধ্যে একটা আনন্দ ও ভক্তিরসের সঞ্চার হইত। তবু গোরা ছাড়িল না— লে যথানিয়মে প্রতিদিন পূজায় বসিতে লাগিল, ইহাকে সে নিয়মস্বরূপেই গ্রহণ করিল। মনকে এই বলিয়া বুঝাইল, যেখানে ভাবের সূত্রে সকলের সঙ্গে মিলিবার শক্তি না থাকে সেখানে নিয়মস্বত্রই সর্বত্র মিলন রক্ষা করে। গোরা যখনই গ্রামে গেছে সেখানকার দেবমন্দিরে প্রবেশ করিয়া মনে মনে গভীরভাবে ধ্যান করিয়া বলিয়াছে, এইখানেই আমার বিশেষ স্থান— এক দিকে দেবতা ও এক দিকে ভক্ত— তাহারই মাঝখানে ব্রাহ্মণ সেতুস্বরূপ উভয়ের যোগ রক্ষা করিয়া আছে । ক্রমে গোরার মনে হইল, ব্রাহ্মণের পক্ষে ভক্তির প্রয়োজন নাই । ভক্তি জনসাধারণেরই বিশেষ সামগ্রী । এই ভক্ত ও ভক্তির বিষয়ের মাঝখানে যে সেতু তাহা জ্ঞানেরই সেতু। এই পেতু যেমন উভয়ের যোগ রক্ষা করে তেমনি উভয়ের সীমারক্ষাও করে । ভক্ত এবং দেবতার মাঝখানে যদি বিশুদ্ধ জ্ঞান ব্যবধানের মতো না থাকে তবে সমস্তই বিকৃত হইয়া যায়। এই জন্ত ভক্তিবিহবলতা ব্রাহ্মণের সম্ভোগের সামগ্ৰী নহে, ব্রাহ্মণ জ্ঞানের চূড়ায় বলিয়া এই ভক্তির রসকে সর্বসাধারণের ভোগার্থে বিশুদ্ধ করিয়া রাখিবার জন্ত তপস্তারত । সংসারে যেমন ব্রাহ্মণের জন্ত আরামের ভোগ নাই, দেবার্চনাতেও তেমনি ব্রাহ্মণের জন্ত ভক্তির ভোগ নাই । ইহাই ব্রাহ্মণের গৌরব। সংসারে ব্রাহ্মণের জন্ত নিয়মসংযম এবং ধর্মসাধনায় ব্রাহ্মণের জন্ত জ্ঞান | হৃদয় গোরাকে হার মানাইয়াছিল, হৃদয়ের প্রতি সেই অপরাধে গোরা নির্বাসনদও বিধান করিল। কিন্তু নির্বাসনে তাহাকে লইয়া যাইবে কে ? সে সৈন্ত আছে কোথায় ? l',