পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৫৭৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গোরা (Hථා অথচ আজ র্তাহার আপনার লোক কেহই তাহার কাপড় গুছাইয়া দিতে আসিল না, র্তাহার নিজেকেই এ কাজ করিতে হইতেছে, এই দৃপ্ত দেখিয়া স্বচরিতার মনে খুব একটা আঘাত লাগিল। সে পরেশবাবুকে নিরস্ত করিয়া প্রথমে তাহার তোরঙ্গ সম্পূর্ণ উজার করিয়া ফেলিল। তাহার পরে বিশেষ যত্নে ভাজ করিয়া কাপড়গুলিকে নিপুণহস্তে তোরঙ্গের মধ্যে আবার সাজাইতে লাগিল, এবং তাহার সর্বদাপাঠ্য বইগুলিকে এমন করিয়া রাখিল যাহাতে নাড়াচাড়াতেও তাহাঁদের আঘাত না লাগে । এইরূপে বাক্স গুছাইতে গুছাইতে স্বচরিত আস্তে আস্তে জিজ্ঞাসা করিল, “বাবা, তুমি কি একলাই যাবে ?” পরেশ স্বচরিতার এই প্রশ্নের মধ্যে বেদনার আভাস পাইয়া কহিলেন, “তাতে আমার তো কোনো কষ্ট নেই রাধে !” স্বচরিতা কহিল, "না বাবা, আমি তোমার সঙ্গে যাব ।” পরেশ স্বচরিতার মুখের দিকে চাহিয়া ছিলেন । স্বচরিতা কহিল, “বাবা, আমি তোমাকে কিছু বিরক্ত করব না।” পরেশ কহিলেন, “সে কথা কেন বলছ ? আমাকে তুমি কবে বিরক্ত করেছ মা ?” স্বচরিতা কহিল, "তোমার কাছে না থাকলে আমার ভালো হবে না বাবা ! আমি অনেক কথাই বুঝতে পারি নে। তুমি আমাকে বুঝিয়ে না দিলে আমি কিনারা পাব না । বাবা, তুমি যে আমাকে আমার নিজের বুদ্ধির উপরে নির্ভর করতে বল— আমার সে বুদ্ধি নেই, আমি মনের মধ্যে সে জোরও পাচ্ছি নে ! তুমি আমাকে তোমার সঙ্গে নিয়ে চলে! বাবা !" এই বলিয়া সে পরেশের দিকে পিঠ করিয়া অত্যন্ত নতশিরে তোরঙ্গের কাপড় লইয়া পড়িল । তাহার চোখ দিয়া টপ টপ করিয়া জল পড়িতে লাগিল । Գ(t গোরা লিখনটি লিখিয়া যখন হরিমোহিনীর হাতে দিল তখন তাহার মনে হইল স্বচরিতা সম্বন্ধে সে যেন ত্যাগপত্র লিখিয়া দিল । কিন্তু দলিল লিখিয়া দিলেই তো তখনই কাজ শেষ হয় না । তাহার হৃদয় যে সে দলিলকে একেবারে অগ্রাহ করিয়া দিল । সে দলিলে কেবল গোরার ইচ্ছাশক্তি জোর কলমে নামসই করিয়া দিয়াছিল বটে, কিন্তু তাহার হৃদয়ের স্বাক্ষর তো তাহতে ছিল না— হৃদয় তাই অবাধ্য হইয়াই রহিল। এমনি ঘোরতর অবাধ্যতা যে, সেই রাত্রেই গোরাকে একবার স্বচরিতার বাড়ির দিকে দৌড় করাইয়াছিল আর-কি। কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তেই গির্জার ঘড়িতে