পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৯৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ডেকে নিয়ে আয় | তাকে কেন মহারাজ ! বৈরাগ্য সাধন করব । সেই খবর শুনেই তো ছুটে এসেছি, এ সাধনায় আমিই তো আপনার সহচর। মহারাজ, আমরাই তাে পৃথিবীতে আছি মানুষের আসক্তি মােচন করবার জন্য। বুঝতে পারলুম না। এতদিন কাব্য শুনিয়ে এলুম। তবু বুঝতে পারলেন না ? আমাদের কথার মধ্যে বৈরাগ্য, সুরের মধ্যে বৈরাগ্য, ছন্দের মধ্যে বৈরাগ্য। সেইজন্যই তাে লক্ষ্মী আমাদের ছাড়েন, আমরাও লক্ষ্মীকে ছাড়বার জন্যে যৌবনের কানে মন্ত্র দিয়ে বেড়াই । তোমাদের মন্ত্রটা কী । A. আমাদের মন্ত্র এই যে, ওরে ভাই, ঘরের কোণে তোদের থলি-থালি আঁকড়ে বসে থাকিস নেবেড়িয়ে পড় প্রাণের সদর রাস্তায় ওরে যৌবনের বৈরাগীর দল। সংসারের পথটাই বুঝি তোমার বৈরাগ্যের পথ হল ? তা নয়তো কী মহারাজ ! সংসারে যে কেবলই সরা, কেবলই চলা ; তারই সঙ্গে সঙ্গে যে-লোক একতারা বাজিয়ে নৃত্য করতে করতে কেবলই সরে, কেবলই চলে, সে-ই তো বৈরাগী, সে-ই তো পথিক, সে-ই তো কবি-বাউলের চেলা । তা হলে শান্তি পাব। কী করে । শান্তির উপরে তো আমাদের একটুও আসক্তি নেই, আমরা যে বৈরাগী । কিন্তু ধ্রুব সম্পদটি তো পাওয়া চাই। ধ্রুব সম্পদে আমাদের একটুও লোভ নেই, আমরা যে বৈরাগী । সে কী কথা।— বিপদ বাধাবে দেখছি। ওরে শ্রুতিভূষণকে ডাক । আমরা অধ্ৰুব মন্ত্রের বৈরাগী। আমরা কেবলই ছাড়তে ছাড়তে পাই, তাই ধুবঁটাকে মানি নে। এ তোমার কিরকম কথা । পাহাড়ের গুহা ছেড়ে যে-নদী বেরিয়ে পড়েছে তার বৈরাগ্য কি দেখেন নি মহারাজ। সে অনায়াসে আপনাকে ঢেলে দিতে দিতেই আপনাকে পায়। নদীর পক্ষে ধ্রুব হচ্ছে বালির মরুভূমি- তার মধ্যে সোধলেই বেচারা গেল । তার দেওয়া যেমনি ঘোচে অমনি তার পাওয়াও ঘোচে । ঐ শোনো কবিশেখর, কান্না শোনো। ঐ তো তোমার সংসার ! ওরা মহারাজের দুৰ্ভিক্ষকতর প্রজা। আমার প্রজা ? বল কী কবি। সংসারের প্রজা ওরা। এ দুঃখ কি আমি সৃষ্টি করেছি। তোমার কবিত্বমন্ত্রের বৈরাগীরা এ দুঃখের কী প্ৰতিকার করতে পারে বলো তো । মহারাজ, এ দুঃখকে তো আমরাই বহন করতে পারি। আমরা যে নিজেকে ঢেলে দিয়ে বয়ে চলেছি। নদী কেমন করে ভার বহন করে দেখেছেন তো ? মাটির পাকা রাস্তাই হল যাকে বলেন ধ্রুব, তাই তো ভারকে কেবলই সে ভারী করে তোলে ; বোঝা তার উপর দিয়ে আর্তনাদ করতে করতে চলে, আর তারও বুক ক্ষত-বিক্ষত হয়ে যায়। নদী আনন্দে বয়ে চলে, তাই তো সে আপনার ভার লাঘব করেছে বলেই বিশ্বের ভার লাঘব করে। আমরা ডাক দিয়েছি সকলের সব সুখ-দুঃখকে চলার লীলায় বয়ে নিয়ে যাবার জন্যে। আমাদের বৈরাগীর ডাক। আমাদের বৈরাগীর সর্দার যিনি, তিনি এই সংসারের পথ দিয়ে নেচে চলেছেন, তাই তো বসে থাকতে পারি নে পথ দিয়ে কে যায় গো চলে ডাক দিয়ে সে যায়। আমার ঘরে থাকাই দায় । ।