পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪০০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

VObr8 রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী পথের হাওয়ায় কী সুর বাজে, কাজে বেদনায় । আমার ঘরে থাকাই দায় । । যাক গে শ্রুতিভূষণ। ওহে কবিশেখর, আমার কী মুশকিল হয়েছে জানাে। তোমার কথা আমি এক বিন্দুবিসর্গও বুঝতে পারি নে, অথচ তোমার সুরটা আমার বুকে গিয়ে বাজে। আর শ্রুতিভূষণের ঠিক তার উলটাে ; তার কথাগুলো খুবই স্পষ্ট বোঝা যায় হে- ব্যাকরণের সঙ্গেও মেলে- কিন্তু সুরটা— সে কী আর বলব । মহারাজ, আমাদের কথা তো বোঝবার জন্যে হয় নি, বাজবার জন্যে হয়েছে । এখন তােমার কাজটা কী বলে তো কবি। মহারাজ, ঐ-যে তোমার দরজার বাইরে কান্না উঠেছে। ঐ কান্নার মাঝখান দিয়ে এখন ছুটতে হবে । ওহে কবি, বল কী তুমি । এ-সমস্ত কেজো লোকের কাজ, দুর্ভিক্ষের মধ্যে তোমরা কী করবে। কেজো লোকেরা কাজ বেসুরো করে ফেলে, তাই সুর বঁাধবার জন্যে আমাদের ছুটে আসতে হয় । ওহে কবি, আর-একটু স্পষ্ট ভাষায় কথা কও । মহারাজ, ওরা কর্তব্যকে ভালোবাসে ব’লে কাজ করে, আমরা প্ৰাণকে ভালোবাসি বলে কাজ করি।- এইজন্যে। ওরা আমাদের গাল দেয়, বলে নিষ্কৰ্মা, আমরা ওদের গাল দিই, বলি নিজীব | কিন্তু জিতটা হল কার । আমাদের, মহারাজ, আমাদের । তার প্রমাণ ? পৃথিবীতে যা-কিছু সকলের বড়ো তার প্রমাণ নেই। পৃথিবীতে যত কবি যত কবিত্ব সমস্ত যদি ধুয়ে-মুছে ফেলতে পাের তা হলেই প্রমাণ হবে এতদিন কেজো লোকেরা তাদের কাজের জোরটা কোথা থেকে পাচ্ছিল, তাদের ফসলখেতের মূলের রস জুগিয়ে এসেছে কারা। মহারাজ, আপনার দরজার বাইরে ঐ-যে কান্না উঠেছে সে কান্না থামায় কারা। যারা বৈরাগ্যবারিধির তলায় ডুব মেরেছে তারা নয়, যারা বিষয়কে আঁকড়ে ধরে রয়েছে তারা নয়, যারা কাজের কৌশলে হাত পাকিয়েছে তারাও নয়, যারা কর্তব্যের শুষ্ক রুদ্রাক্ষের মালা জপছে তারাও নয়, যারা অপৰ্যাপ্ত প্ৰাণকে বুকের মধ্যে পেয়েছে বলেই জগতের কিছুতে যাদের উপেক্ষা নেই, জয় করে তারা, ত্যাগ করেও তারাই, বাঁচতে জানে তারা, মরতেও জানে তারা, তারা জোরের সঙ্গে দুঃখ পায়, তারা জোরের সঙ্গে দুঃখ দূর করে— সৃষ্টি করে তারাই, কেননা তাদের মন্ত্র আনন্দের মন্ত্র, সব চেয়ে বড়ো বৈরাগ্যের মন্ত্র । ওহে কবি, তা হলে তুমি আমাকে কী করতে বল। . উঠতে বলি মহারাজ, চলতে বলি। ঐ-যে কান্না, ও-যে প্রাণের কাছে প্ৰাণের আহবান । কিছু করতে পারর কি না সে পরের কথা- কিন্তু ডাক শুনে যদি ভিতরে সাড়া না দেয়, প্ৰাণ যদি না দুলে ওঠে তবে অকর্তব্য হল বলে ভাবনা নয়, তবে ভাবনা মরেছি বলে ।