পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৪৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

দুই বোন r 8总公 এককোণে কুল, হঠাৎ মনে হল চৌকির উপরে যে সবুজ রঙের ঢাকাটা আছে সে-রঙটা ও দু-চক্ষে দেখতে পারে না। বেহারা বারান্দা ঝাড় দিচ্ছিল, ধুলো উড়ছে বলে তাকে দিল একটা প্রকাণ্ড ধমক ৷ অনিবাৰ্য ধুলো রোজই ওড়ে। কিন্তু ধমকটা সদ্য নূতন । অসম্মানের খবরটা স্ত্রীকে জানালে না । ভাবলে যদি কানে ওঠে তা হলে চাকরির জালটাতে আরো একটা গ্ৰন্থি পাকিয়ে তুলবে— হয়তো বা স্বয়ং কর্তৃপক্ষের সঙ্গে ঝগড়া করে আসবে অমধুর ভাষায় । বিশেষত ঐ ডোনাল্ডসনের উপর তার রাগ আছে। একবার সে সার্কিট-হাউসের বাগানে বঁাদরের উৎপাত দমন করতে গিয়ে ছররা-গুলিতে শশাঙ্কর সোলার টুপি ফুটাে করে দিয়েছে। বিপদ ঘটে নি কিন্তু ঘটতে তো পারত। লোকে বলে দোষ শশাঙ্করই, শুনে তার রাগ আরো বেড়ে ওঠে ডোনাল্ডসনের পরেই। সকলের চেয়ে রাগের কারণটা এই বঁােদরকে লক্ষ্য-করা গুলি শশাঙ্কের উপর পড়াতে শত্রুপক্ষ এই দুটাে ব্যাপারের সমীকরণ করে উচ্চহাস্য করেছে। শশাঙ্কের পদলাঘবের খবরটা শশাঙ্কের স্ত্রী স্বয়ং আবিষ্কার করলে। স্বামীর রকম দেখেই বুঝেছিল সংসারে কোনো দিক থেকে একটা কাটা উচিয়ে উঠেছে। তার পরে কারণ বের করতে- সময় লাগে নি। কনস্টিট্র্যাশনাল অ্যাজিটেশনের পথে গেল না, গেল সেলফ-ডিটামিনেশনের অভিমুখে । স্বামীকে বললে, “আর নয়, এখনই কাজ ছেড়ে দাও।” দিতে পারলে অপমানের জোকটা বুকের কাছ থেকে খসে পড়ে। কিন্তু ধ্যানদৃষ্টির সামনে প্রসারিত রয়েছে বাধা মাইনের অন্নক্ষেত্র, এবং তার পশ্চিমদিগন্তে পেনসনের অবিচলিত স্বর্ণোজুল রেখা। " শশাঙ্কমীেলী যে-বছরে এম. এসসি. ডিগ্রির সর্বোচ্চ শিখরে সদ্য অধিরূঢ়, সেই বছরেই তার শ্বশুর। শুভকর্মে বিলম্ব করেন নি- শশাঙ্কের বিবাহ হয়ে গেল শর্মিলার সঙ্গে ৷ ধনী শ্বশুরের সাহায্যেই এঞ্জিনিয়ারিং পাস করলে। তার পরে চাকরিতে দ্রুত উন্নতির লক্ষণ দেখে রাজারামবাবু জামাতার ভাবী সচ্ছলতার ক্রমবিকাশ নির্ণয় করে আশ্বস্ত হয়েছিলেন । মেয়েটিও আজ পর্যন্ত অনুভব করে নি, তার অবস্থান্তর ঘটেছে। শুধু যে সংসারে অনটন নেই তা নয়, বাপের বাড়ির চালচলন। এখানেও বজায় আছে । তার কারণ, এই পারিবারিক দ্বৈরাজ্যে ব্যবস্থাবিধি শামিলার অধিকারে । ওর সন্তান হয় নি, হবার আশাও বোধ করি ছেড়েছে। স্বামীর সমস্ত উপাৰ্জন অখণ্ডভাবে এসে পড়ে ওরই হাতে । বিশেষ প্রয়োজন ঘটলে ঘরের অন্নপূর্ণার কাছে ফিরে ভিক্ষা না মেগে শশাঙ্কর উপায় নেই। দাবি অসংগত হলে নামঞ্জুর হয়, মেনে নেয় মাথা চুলকিয়ে । অপর কোনো দিক থেকে নৈরাশ্যটা পূরণ হয় মধুর রসে । শশাঙ্ক বললে, “চাকরি ছেড়ে দেওয়া আমার পক্ষে কিছুই নয় । তোমার জন্যে ভাবি, কষ্ট হবে তোমারই ।” শর্মিলা বললে, “তার চেয়ে কষ্ট হবে যখন অন্যায়টাকে গিলতে গিয়ে গলায় বাধবে ।” শশাঙ্ক বললে, “কাজ তো করা চাই, ধ্রুবকে ছেড়ে অধ্রুবকে খুঁজে বেড়াব কোন পাড়ায় ।” "সে-পাড়া তোমার চোখে পড়ে না। তুমি যাকে ঠাট্টা করে বল তোমার চাকরির লুচি-স্থান, বেলুচিস্থান মরুপ্রদেশের ও পারে, তার বাইরের বিশ্বব্ৰহ্মাণ্ডকে তুমি গণ্যই কর না ।” "সর্বনাশ । সে বিশ্বব্ৰহ্মাণ্ড যে মস্ত প্ৰকাণ্ড । রাস্তাঘাট সার্ভে করতে বেরোবে কে । অতবড়ো দূরবীন পাই কোন বাজারে।” "মস্ত দূরবীন তোমাকে কষতে হবে না। আমার জ্ঞাতিসম্পর্কের মথুরদাদা কলকাতার বড়ো কনট্রাক্টর, তার সঙ্গে ভাগে কাজ করলে দিন চলে যাবে।” "ভাগটা ওজনে অসমান হবে । এ পক্ষে বাটখারায় কমতি । খুঁড়িয়ে শরিকি করতে গেলে পদমর্যাদা থাকবে না ।” । "এ পক্ষে কোনো অংশেই কমতি নেই। তুমি জানো, বাবা আমার নামে ব্যাঙ্কে যে টাকা রেখে গৈছেন, সুদে বাড়ছে। শরিকের কাছে তোমাকে খাটো হতে হবে না ।” "সে কি হয় । ও টাকা যে তোমার ।” বলে শশাঙ্ক উঠে পড়ল । বাইরে লোক বসে আছে।