পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৫৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

দুই বোন 8w9ዒ বিকেলবেলায় উর্মির তদারক করতে এসে শুনলে সে গেছে ইংরেজি নাট্যশালায় সালিভ্যানের মিক্যাডো অপেরার বৈকালিক অভিনয় দেখবার জন্যে। তার দাদা থাকতে এরকম সুযোগ প্রায় বাদ যেত না । সেদিন নীরদ তাকে যথােচিত তিরস্কার করেছিল। অত্যন্ত গভীর সুরে ইংরেজি ভাষায় বলেছিল, “দেখাে, তােমার দাদার মৃত্যুকে সমস্ত জীবন দিয়ে সার্থক করবার ভার নিয়েছ তুমি । এরই মধ্যে কি তা ভুলতে আরম্ভ করেছ।” শুনে উর্মির অত্যন্ত পরিতাপ লাগল। ভাবলে, “এ মানুষটার কী অসাধারণ অন্তরভৃষ্টি। শোকস্মৃতির প্রবলতা সত্যই তো কমে আসছে- আমি নিজে তা বুঝতে পারি নি। ধিক, এত চাপল্য আমার চরিত্রে।" সতর্ক হতে লাগল, কাপড়-চােপড় থেকে শোভার আভাস পর্যন্ত দূর করলে। শাড়িটা হল মোটা, তার রঙ সব গেল ঘুচে । দেরাজের মধ্যে জমা থাকা সত্ত্বেও চকোলেট খাওয়ার লোভটাকে । দিলে ছেড়ে । অবাধ্য মনটাকে খুব কষে বাধতে লাগল সংকীর্ণ গণ্ডিতে, শুষ্ক কর্তব্যের খোটায়। দিদি তিরস্কার করে, শশাঙ্ক নীরদের উদ্দেশে যে-সব প্রখর বিশেষণ বর্ষণ করে সেগুলোর ভাষা অভিধানবহির্ভূত উগ্র পরদেশীয়, একটুও সুশ্রাব্য নয়। একটা জায়গায় নীরদের সঙ্গে শশাঙ্কের মেলে | শশাঙ্কের গাল দেবার আবেগ যখন তীব্র হয়ে ওঠে তখন তার ভাষাটা হয় ইংরেজি, নীরদের যখন উপদেশের বিষয়টা হয় অত্যন্ত উচ্চশ্রেণীর ইংরেজিই হয় তার বাহন । নীরদের সব চেয়ে খারাপ লাগে যখন নিমন্ত্রণ-আমন্ত্রণে উমি তার দিদির ওখানে যায়। শুধু যায় তা নয়, যাবার ভারি। আগ্রহ। ওদের সঙ্গে উর্মির যে আত্মীয়সম্বন্ধ সেটা নীরদের সম্বন্ধকে খণ্ডিত করে । নীরদ মুখ গভীর করে একদিন উর্মিকে বললে, “দেখো উর্মি, কিছু মনে কোরো না। কী করব বলো, তোমার সম্বন্ধে আমার দায়িত্ব আছে, তাই কর্তব্যবোধে অপ্ৰিয় কথা বলতে হয় । আমি তোমাকে সতর্ক আত্মীয়তার মোহে তুমি অন্ধ, আমি কিন্তু দুৰ্গতির সম্ভাবনা সমস্তই স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি।” উর্মির চরিত্র বললে যে পদার্থটা বোঝায় অন্তত তার প্রথম বন্ধকী দলিল নীরদেরই সিন্ধুকে, সেই চরিত্রের কোথাও কিছু হেরফের হলে লোকসান নীরদেরই। নিষেধের ফলে ভবানীপুর অঞ্চলে উর্মির গতিবিধি আজকাল নানাপ্রকার ছুতোয় বিরল হয়ে এসেছে। উর্মির এই আত্মশাসন মস্ত একটা ঋণশোধের মতো । ওর জীবনের দায়িত্ব নিয়ে নীরদ যে চিরদিনের মতো নিজের সাধনাকে ভারাক্রান্ত করেছে, বিজ্ঞানতপস্বীর পক্ষে তার চেয়ে আত্ম-অপব্যয় আর কী হতে পারে । নানা আকর্ষণ থেকে মনকে প্রতিসংহার করবার দুঃখটা উর্মির একরকম করে সয়ে আসছে। তবুও থেকে থেকে একটা বেদনা মনে দুর্বর হয়ে ওঠে, সেটাকে চঞ্চলতা বলে সম্পূর্ণ চাপা দিতে পারে না । নীরদ ওকে কেবল চালনাই করে, কিন্তু এক মুহুর্তের জন্যে। ওর সাধনা করে না কেন । এই সাধনার জন্যে। ওর মন অপেক্ষা করে থাকে- এই সাধনার অভাবেই ওর হৃদয়ের মাধুর্য পূৰ্ণবিকাশের দিকে পৌছয় না, ওর সকল কর্তব্য নিজীব নীরস হয়ে পড়ে। এক-একদিন হঠাৎ মনে হয়, যেন নীরদের চোখে একটা আবেশ এসেছে, যেন দেরি নেই, প্রাণের গভীরতম রহস্য, এখনই ধরা পড়বে। কিন্তু অন্তর্যামী জানেন, সেই গভীরের বেদনা। যদি বা কোথাও থাকে তার ভাষা নীরদের জানা নেই। বলতে পারে না বলেই বলবার ইচ্ছাকে সে দোষ দেয় । বিচলিত চিত্তকে মুক রেখেই সে যে চলে আসে এটাকে সে আপন শক্তির পরিচয় বলে মনে গর্ব করে । বলে, “সেন্টিমেন্টালিটি করা আমার কর্ম নয় ।” উর্মির সেদিন কঁদতে ইচ্ছা করে, কিন্তু এমনি তার দশা যে সেও ভক্তিভরে মনে করে একেই বলে বীরত্ব | নিজের দুর্বল মনকে তখন নিষ্ঠুরভাবে নির্যাতন করতে থাকে। যত চেষ্টাই করুক-না কেন, মাঝে মাঝে এ কথা ওর কাছে স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, একদিন প্রবল শোকের মুখে যে কঠিন কর্তব্য নিজের ইচ্ছায় সে গ্রহণ করেছিল কালক্রমে নিজের সেই ইচ্ছা দুর্বল হয়ে আসাতে অন্যের ইচ্ছাকেই আঁকড়ে ধরেছে। নীরদ ওকে স্পষ্ট করেই বলে, “দেখো উর্মি, সাধারণ মেয়েরা পুরুষদের কাছ থেকে যে-সব