পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৫৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

দুই বোন 88 ○ সংসারটাকে রক্ষা করা বোন। নইলে নিশ্চিন্ত হয়ে মরতে পারছি নে ৷” এই ইতিহাসটা র্যারা পড়ছেন এই জায়গাটাতে এসে মুচকে হেসে বলবেন ‘‘বুঝেছি । বুঝতে অত্যন্ত বেশি বুদ্ধির দরকার হয় না। যা ঘটবার তাই ঘটে, আর তাই যথেষ্ট । এমনও মনে করবার হেতু নেই ভাগ্যের খেলা চলবে তাসের কাগজ গোপন করে শর্মিলারই চােখে ধুলো দিয়ে । “দিদির সেবা করতে চলেছি, বলে উর্মির মনে খুব একটা উৎসাহ হল। এই কর্তব্যের খাতিতে অন্য সমস্ত কাজকে সরিয়ে রাখতেই হবে। উপায় নেই। তা ছাড়া এই শুশ্রুষার কাজটা ওর ভাবীকালের ডাক্তারি কাজেরই সংলগ্ন, এ তর্কও তার মনে এসেছে। ঘটা করে একটা চামড়া-বাধানো নোটবই নিলে । তার মধ্যে রোগের দৈনিক জোয়ার-ভাটার পরিমাণটাকে রেখাঙ্কিত করবার ছক কাটা আছে। ডাক্তার পাছে অনভিজ্ঞ বলে অবজ্ঞা করে এইজন্যে স্থির করলে দিদির রোগ সম্বন্ধে যেখানে যা পাওয়া যায় পড়ে নেবে। ওর এম. এসসি. পরীক্ষার বিষয় শারীরতত্ত্ব, এইজন্যে রোগতত্ত্বের পারিভাষিক বুঝতে ওর কষ্ট হবে না। অর্থাৎ, দিদির সেবার উপলক্ষে ওর কর্তব্যসূত্র যে ছিন্ন হবে না, বরঞ্চ আরো বেশি একান্তমনে কঠিনতর চেষ্টায় তারই অনুসরণ করা হবে, এ কথাটা মনে সে নিশ্চিত করে নিয়ে ওর পড়বার বই আর খাতপত্র ব্যাগে পুরে ভবানীপুরের বাড়িতে এসে উপস্থিত হল । দিদির ব্যামোটা নিয়ে রোগতত্ত্ব সম্বন্ধে মোটা বইটা নাড়াচাড়া করবার সুযোগ ঘটল না। কেনন’ বিশেষজ্ঞেরাও রোগের সংজ্ঞা নির্ণয় করতে পারলে না। উর্মি ভাবলে, সে শাসনকর্তার কাজ পেয়েছে। তাই সে গভীরমুখে দিদিকে বললে, “ডাক্তারের শুভূড়ান্টু তাই দেখবার ভার আমার উপর আমার কথা কিন্তু মেেন চলতে হবে আমি তােমাকে বলে রাখছি। ” দিদি ওর দায়িত্বের আড়ম্বর দেখে হেসে বললে, “তই তো, হঠাৎ এত গভীর হতে শিখলে কোন গুরুর কাছে। নতুন দীক্ষা বলেই এত বেশি উৎসাহ । আমারই কথা মেনে চলবি বলেই তোকে আমি | ডেকেছি। তোর হাসপাতাল তো এখনো তৈরি হয় নি, আমার ঘরকন্না তৈরি হয়েই আছে । আপাতত সেই ভারটা নে, তোর দিদি একটু ছুটি পাক ৷” রোগশয্যার কাছ থেকে উর্মিকে জোর করেই দিদি সরিয়ে দিলে । আজ দিদির গৃহরাজ্যে প্রতিনিধিপদ ওর। সেখানে অরাজকতা ঘটছে, আশু তার প্রতিবিধান চাই। এ সংসারের সর্বোচ্চ শিখরে একটিমাত্র যে পুরুষ বিরাজ করছেন তার সেবায় সামান্য কোনোক্রটিনা হয়, এই মহৎ উদ্দেশ্যে সম্পূর্ণ ত্যাগন্ধীকার এই ঘরের ছােটাে বড়ো সমস্ত অধিবাসীর একটিমাত্র সাধনার বিষয়। মানুষটি নিরতিশয় নিরুপায় এবং দেহযাত্ৰানির্বাহে শোচনীয়ভাবে অকৰ্মণ্য, এই সংস্কার কোনোমতেই শর্মিলার মন থেকে ঘুচিতে চায় না । হাসিও পায়, অথচ মনটা স্নেহসিক্ত হয়ে ওঠে, যখন দেখে চুরাটের আগুনে ভদ্রলোকের আস্তিন খানিকটা পুড়েছে, অথচ লক্ষই নেই। ভোরবেলায় মুখ ধুয়ে শোবার ঘরের কোণের কলটা খুলে রেখে এঞ্জিনিয়র কাজের তাড়ায় দৌড় দিয়েছে বাইরে, ফিরে এসে দেখে মেজে জলে থই-থই করছে, নষ্ট হয়ে গেল কাপেটটা । এই জায়গায় কলটা বসাবার সময়ে গোড়াতেই আপত্তি করেছিল। শৰ্মিলা। জানত এই পুরুষটির হাতে বিছানার অদূরে ঐ কোনটাতে প্রতিদিন জলে-স্থলে একটা পঙ্কিল অনাসৃষ্টি বাঁধবে। কিন্তু মস্ত এঞ্জিনিয়র, বৈজ্ঞানিক সুবিধার দোহাই দিয়ে যতরকম অসুবিধাকে জটিল করে তুলতেই ওর উৎসাহ । খামক কী মাথায় এল একবার, নিজের সম্পূর্ণ ওরিজিনাল প্ল্যানে একটা স্টেভ বানিয়ে বসল। তার এ দিকে দরজা, ও দিকে দরজা ; এ দিকে একটা চোঙ, ও দিকে আর-একটা ; এক দিকে আগুনের অপব্যয়হীন উদ্দীপন, আর-এক দিকে ঢালু। পথে ছাইয়ের নিঃশেষে অধঃপতন— তার পরে সেঁকবার ভাঁজবার সিদ্ধ-করবার জল-গরমের নানা আকারের খোপখাপ, গুহাগহবর, কলাকৌশল। কলটাকে উৎসাহের ভঙ্গিতে ও ভাষাতেই মেনে নিতে হয়েছিল, ব্যবহারের জন্যে নয়, শান্তি ও সদভাব। -রক্ষার জন্যে। প্রাপ্তবয়স্ক শিশুদের এই খেলা ! বাধা দিলে অনৰ্থ বাধে, অথচ দুদিনেই যায় ভুলে। চিরদিনের বাধা ব্যবস্থায় মন যায় না, উদ্ভট একটা-কিছু সৃষ্টি করে, আর স্ত্রীদের দায়িত্ব হচ্ছে মুখে ওদের মতে সায়