পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৬৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

88br রবীন্দ্র-রচনাবলী বার বার করে বলছে, “মরবার আগে ঐ কথাটুকু বুঝে গেলুম। আর সবই করেছি, কেবল খুশি করতে পারি নি। ভেবেছিলুম উর্মিমালার মধ্যে নিজেকেই দেখতে পাব, কিন্তু ও তো আমি নয়, ও যে সম্পূর্ণ আর-এক মেয়ে।” জানলার বাইরের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে ভাবে, “আমার জায়গা ও নেয় নি, ওর জায়গা আমি নিতে পারব না। আমি চলে গেলে ক্ষতি হবে, কিন্তু ও চলে গেলে সব শূন্য হবে। ভাবতে ভাবতে হঠাৎ মনে পড়ে গেল— শীতের দিন আসছে, গরম কাপড়গুলো রোদদূরে দেওয়া চাই । উমি তখন শশাঙ্কের সঙ্গে পিংপং খেলছিল, ডেকে পাঠালে । বললে, “উমি, এই নে চাবি । গরম কাপড়গুলো ছাদের উপর রোদে মেলে দে গে।” উর্মি আলমারিতে চাবি সবেমাত্র লাগিয়েছে এমন সময় শশাঙ্ক এসে বললে, “ও-সব পরে হবে, ঢের সময় আছে। খেলাটা শেষ করে যাও ।” দিদি ছুটি দিলে, সেইসঙ্গে বড়ো একটা দীর্ঘনিশ্বাস পড়ল । দাসীকে ডেকে বললে, “দে তো আমার মাথায় ঠাণ্ডা জলের পটি ” যদিও অনেক দিন পরে হঠাৎ উর্মি ছাড়া পেয়ে যেন আত্মবিস্মৃত হয়ে গিয়েছিল, তবু সহসা এক-এক দিন মনে পড়ত ওর জীবনের কঠিন দায়িত্ব । ও তো স্বাধীন নয়, ও যে বাধা ওর ব্ৰতের সঙ্গে । তারই সঙ্গে মিলিয়ে যে বাধন ওকে ব্যক্তিবিশেষের সঙ্গে বেঁধেছে। তার অনুশাসন আছে ওর ’পরে। ওর দৈনিক কর্তব্যের খুঁটিনাটি সেই তো স্থির করে দিয়েছে। ওর জীবনের পরে তার চিরকালের অধিকার, এ কথা উমি কোনোমতে অস্বীকার করতে পারে না । যখন নীরদ উপস্থিত ছিল স্বীকার করা সহজ ছিল, জোর পেত। মনে । এখন ওর ইচ্ছে একেবারেই বিমুখ হয়ে গেছে, অথচ কর্তব্য বুদ্ধি তাড়া দিচ্ছে। কর্তব্য বুদ্ধির অত্যাচারেই মন আরো যাচ্ছে বিগড়িয়ে । নিজের অপরাধ ক্ষমা করা কঠিন হয়ে উঠল বলেই অপরাধ প্রশ্রয় পেতে লাগিল । বেদনায় আফিমের প্রলেপ দেবার জন্যে শশাঙ্কের সঙ্গে খেলায় আমোদে নিজেকে সর্বক্ষণ ভুলিয়ে রাখতে চেষ্টা করে। বলে, যখন সময় আসবে তখন আপনি সব ঠিক হয়ে যাবে, এখন যে-কয়দিন ছুটি ও-সব কথা থাক। আবার হঠাৎ এক-এক দিন মাথা বঁকানি দিয়ে বই-খাতা ট্রাঙ্কের থেকে বের করে তার উপরে মাথা গুজে বসে । তখন শশাঙ্কর পালা । বইগুলো টেনে নিয়ে পুনরায় বাক্সজাত ক’রে সেই বাক্সর উপর সে চেপে বসে। উমি বলে, “শশাঙ্কদা, ভারি অন্যায় | আমার সময় নষ্ট কোরো না ।” শশাঙ্ক বলে, “তোমার সময় নষ্ট করতে গেলে আমারও সময় নষ্ট । অতএব শোধবােধ ।” তার পরে খানিকক্ষণ কড়াকড়ির চেষ্টা করে অবশেষে উর্মি হার মানে। সেটা যে ওর পক্ষে নিতান্ত আপত্তিজনক তা মনে হয় না । এইরকম বাধা পেলেও কর্তব্য বুদ্ধির পীড়ন দিন পাঁচ-ছয় একাদিক্ৰমে চলে, তার পরে আবার তার জোর কমে যায়। বলে, “শশাঙ্কদা, আমাকে দুর্বল মনে কোরো না । মনের মধ্যে প্রতিজ্ঞা দৃঢ় করেই রেখেছি।” “অর্থাৎ ?” “অর্থাৎ, এখানে ডিগ্রি নিয়ে য়ুরোপে যাব ডাক্তারি শিখতে ।” “তার পরে ?” । “তার পরে হাসপাতাল প্ৰতিষ্ঠা করে তার ভার নেব ।” “আর কার ভার নেবে। ঐ-যে নীরদ মুখুজে বলে একটা ইনসাফারেবল—” শশাঙ্কের মুখ চাপা দিয়ে উর্মি বলে, “চুপ করে । এই সব কথা বল যদি তোমার সঙ্গে একেবারে ঝগড়া হয়ে যাবে ।” নিজেকে উমি খুব কঠিন করে বলে, “সত্য হতে হবে। আমাকে, সত্য হতে হবে।” নীরদের সঙ্গে ওর যে সম্বন্ধ বাবা স্বয়ং স্থির করে দিয়েছেন তার প্রতি খাটি না হতে পারাকে ও অসতীত্ব বলে মনে করে ।