পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৮৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8\ኃbr রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী “কাল রাত্রে আপিসের তালা ভেঙে টাকা-চুরির খবর এসেছে।” “টানাটানি করে কি পাচ মিনিটও সময় দিতে পারতেন না ।” “কাল রাত্রে তোমার ব্যথা, বেড়েছিল। ভোরবেলায় ঘুমিয়ে পড়েছিলে । দরজার কাছ পৰ্যন্ত এসে ফিরে গেলেন। আমাকে বলে গেলেন দুপুরের মধ্যে যদি নিজে না আসতে পারেন এই ফুলটি যেন দিই তোমাকে ৷” r দিনের কাজ আরম্ভের পূর্বেই রোজ আদিত্য বিশেষ বাছাই-করা একটি করে ফুল স্ত্রীর বিছানায় রেখে যেত। নীরজা প্রতিদিন তারই অপেক্ষা করেছে। আজকের দিনের বিশেষ ফুলটি আদিত্য সরলার হাতে দিয়ে গেল। এ কথা তার মনে আসে নি যে, ফুল দেওয়ার প্রধান মূল্য নিজের হাতে দেওয়া । গঙ্গার জল হলেও নলের ভিতর থেকে তার সার্থকতা থাকে না । নীরজা ফুলটা অবজ্ঞার সঙ্গে ঠেলে দিয়ে বললে, “জান মার্কেটে এ ফুলের দাম কত ? পাঠিয়ে দাও সেখানে, মিছে নষ্ট করবার দরকার কী ?” বলতে বলতে গলা ভার হয়ে এল । সরলা বুঝলে ব্যাপারখানা। বুঝলে জবাব দিতে গেলে আক্ষেপের বেগ বাড়বে বৈ কমবে না। চুপ করে রইল দাড়িয়ে । একটু পরে খামখা নীরজা প্রশ্ন করলে, “জান এ ফুলের নাম ?” বললেই হত, জানি নে, কিন্তু বোধ করি অভিমানে ঘা লাগল, বললে, “এমারিলিস ।” নীরজা অন্যায়। উস্মার সঙ্গে ধমক দিলে, “ভারি তো জান তুমি ; ওর নাম গ্র্যান্ডিফ্লোরা ।” সরলা মৃদুস্বরে বললে, “তা হবে।” “তা হবে মানে কী । নিশ্চয়ই তাই । বলতে চাও, আমি জানি নে ?” সরলা জানত নীরজা জেনেশুনেই ভুল নামটা দিয়ে প্রতিবাদ করলে । অন্যকে জ্বালিয়ে নিজের জ্বালা উপশম করবার জন্যে । নীরবে হার মেনে ধীরে ধীরে বেরিয়ে চলে যাচ্ছিল, নীরজা ফিরে ডাকল, “শুনে যাও । কী করছিলে সমস্ত সকাল, কোথায় ছিলো।” “অর্কিন্ডের ঘরে ।” নীরজা উত্তেজিত হয়ে বললে, “আর্কিন্ডের ঘরে তোমার ঘন ঘন যাবার এত কী দরকার ।” “পুরোনো অর্কিড চিরে ভাগ করে নতুন আর্কিড করবার জন্যে আদিতদা আমাকে বলে গিয়েছিলেন ।” নীরজা বলে উঠল ধমক দেওয়ার সুরে, “আনাড়ির মতো সব নষ্ট করবে তুমি । আমি নিজের হাতে হল মালীকে তৈরি করে শিখিয়েছি, তাকে হুকুম করলে সে কি পারত না ।” এর উপর জবাব চলে না । এর অকপট উত্তরটা ছিল এই যে, নীরজার হাতে হলা মালীর কাজ ভালোই, কিন্তু সরলার হাতে একেবারেই চলে না । এমন-কি, ওকে সে অপমান করে ঔদাসীন্য

  • মালী এটা বুঝে নিয়েছিল যে, এ আমলে ঠিকমত কাজ না করলেই ও-আমলের মনিব হবেন খুশি । এ যেন কলেজ বয়কট করে পাস না করার দামটাই ডিগ্রি পাওয়ার চেয়ে বড়ো হয়েছে ।

সরলা রাগ করতে পারত। কিন্তু রাগ করলে না । সে বোঝে বউদিদির বুকের ভিতরটা টনটন করছে। নিঃসন্তান মায়ের সমস্ত হৃদয় জুড়েছে যে বাগান, দশ বছর পরে আজ এত কাছে আছে, তবু এই বাগানের থেকে নির্বােসন। চােখের সামনেই নিষ্ঠুর বিচ্ছেদ । নীরজা বললে, “দাও, বন্ধ করে দাও ঐ জানলা।” সরলা বন্ধ করে দিয়ে জিজ্ঞাসা করলে, “এইবার কমললেবুর রস নিয়ে আসি ?” “না, কিছু আনতে হবে না, এখন যেতে পারো ।” সরলা ভয়ে ভয়ে বললে, “মকরধ্বজ খাবার সময় হয়েছে।” জন্ম: দরকার নেই। মকরধ্বজ। তােমার উপর বাগানের আর কােনাে কাজের ফরমাশ আগে " “গোলাপের ডাল পুঁততে হবে ।” r নীরজা একটু খোটা দিয়ে বললে, “তার সময় এই বুঝি ! এ বুদ্ধি তাকে দিলে কে শুনি ৷”