পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫২১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

স্বদেশ १०१ আছি- যদি আমাদের ছাত্রবৃন্দ বলে, সংযম আমাদের পক্ষে অসাধ্য, শরীরের সম্পূর্ণতা লাভের জন্য প্রতীক্ষা করতে আমরা নিতান্তই অসমর্থ অকালে অপবিত্র দাম্পত্য আমাদের পক্ষে অত্যাবশ্যক এবং : হিন্দুয়ানিরও সেই বিধান- আমরা চাই নে উন্নতি, চাই নে ঝঞ্জাট- আমাদের এইরকম ভাবেই বেশ চলে যাবে- তবে নিরুত্তর হয়ে থাকতে হয়। কিন্তু এ কথাটুকু বলতেই হয় যে, হীনতাকে হীনতা বলে অনুভব করাও ভালো, কিন্তু বুদ্ধিবলে নিজীবতাকে সাধুতা এবং অক্ষমতাকে সর্বশ্রেষ্ঠতা বলে প্রতিপন্ন করলে সদগতির পথ একেবারে আটঘাটে বন্ধ করা হয়। সর্বাঙ্গীণ মনুষ্যত্বের প্রতি যদি আমাদের শ্রদ্ধা ও বিশ্বাস থাকে তা হলে এত কথা ওঠে না। তা হলে । কৌশলীসাধ্য ব্যাখ্যা দ্বারা আপনাকে ভুলিয়ে কতকগুলো সংকীর্ণ বাহ্য সংস্কারের মধ্যে আপনাকে বদ্ধ করার প্রবৃত্তিই হয় না । আমরা যখন একটা জাতির মতো জাতি ছিলুম তখন আমাদের যুদ্ধ বাণিজ্য শিল্প, দেশে বিদেশে গতায়াত, বিজাতীয়দের সঙ্গে বিবিধ বিদ্যার আদানপ্রদান, দিগবিজয়ী বল এবং বিচিত্ৰ ঐশ্বৰ্য ছিল। আজ বহু বৎসর এবং বহু প্ৰভেদের ব্যবধান থেকে কালের সীমান্ত-দেশে আমরা সেই ভারতসভ্যতাকে পৃথিবী হতে অতিদূরবতী একটি তপঃপূত হােমধূমরচিত অলৌকিক সমাধিরাজ্যের মতো দেখতে পাই । এবং আমাদের এই বর্তমান স্নিগ্ধচ্ছায়া কর্মহীন নিদ্রালিস নিস্তব্ধ পল্লিটির সঙ্গে তার কতকটা ঐক্য অনুভব করে থাকি, কিন্তু সেটা কখনোই প্রকৃত নয়। 8 আমরা যে কল্পনা করি আমাদের কেবল আধ্যাত্মিক সভ্যতা ছিল- আমাদের উপবাসক্ষীণ পূর্বপুরুষেরা প্রত্যেকে একলা একলা বসে আপন আপন জীবাত্মটি হাতে নিয়ে কেবলই শান দিতেন— তাকে একেবারে কর্মতীত অতিসূক্ষ্ম জ্যোতির রেখাটুকু করে তোলবার চেষ্টা- সেটা নিতান্ত কল্পনা ! আমাদের সেই সর্বাঙ্গসম্পন্ন প্ৰাচীন সভ্যতা বহু দিন হল পঞ্চােত্ব প্ৰাপ্ত হয়েছে, আমাদের বর্তমান সমাজ তারই প্রেতিযোনি মাত্র। আমাদের অবয়ব-সাদৃশ্যের উপর ভর করে আমরা মনে করি আমাদের প্রাচীন সভ্যতারও এইরূপ দেহের লেশমাত্র ছিল না, কেবল একটা ছায়াময় আধ্যাত্মিকতা ছিল । তাতে ক্ষিত্যপতেজের সংস্রবমাত্র ছিল না, ছিল কেবল খানিকটা মরুৎ এবং ব্যোম । এক মহাভারত পড়লেই দেখতে পাওয়া যায় আমাদের তখনকার সভ্যতার মধ্যে জীবনের আবেগ । কত বলবান ছিল । তার মধ্যে কত পরিবর্তন, কত সমাজবিপ্লব, কত বিরোধী শক্তির সংঘর্ষ দেখতে পাওয়া যায়। সে সমাজ কোনো-একজন পরম বুদ্ধিমান শিল্পচতুর লোকের স্বহস্তেরচিত অতি সুচারু পরিপাটি সমভাববিশিষ্ট কলের সমাজ ছিল না । সে সমাজে এক দিকে লোভ হিংসা ভয় দ্বেষ অসংযত অহংকার, অন্য দিকে বিনয় বীরত্ব আত্মবিসর্জন উদার মহত্ত্ব এবং অপূর্ব সাধুভাব মনুষ্যচরিত্রকে সর্বদা মথিত করে জাগ্রত করে রেখেছিল। সে সমাজে সকল পুরুষ সাধু, সকল স্ত্রী সতী, সকল ব্ৰাহ্মণ তপঃপরায়ণ ছিলেন না। সে সমাজে বিশ্বামিত্র ক্ষত্ৰিয়’ছিলেন, দ্ৰোণ কৃপ পরশুরাম ব্ৰাহ্মণ ছিলেন, কুন্তী সতী ছিলেন, ক্ষমাপরায়ণ যুধিষ্ঠির ক্ষত্ৰিয় পুরুষ ছিলেন এবং শত্রুরক্তলোলুপা তেজস্বিনী দ্ৰৌপদী রমণী ছিলেন । তখনকার সমাজ” ভালেীয়-মন্দয় আলোকে-অন্ধকারে জীবনলক্ষণােক্রান্ত ছিল ; মানবসমাজ চিহ্নিত বিভক্ত সংযত সমাহিত কারুকার্যের মতো ছিল না। এবং সেই বিপ্লবসংক্ষুব্ধ বিচিত্র মানববৃত্তির সংঘাত দ্বারা সর্বদা জাগ্ৰতশক্তিপূর্ণ সমাজের মধ্যে আমাদের প্রাচীন বৃঢ়োরস্ক শালপ্ৰাংশু সভ্যতা উন্নতমন্তকে বিহার করত । । সেই প্ৰবল বেগবান সভ্যতাকে আজ আমরা নিতান্ত নিরীহ নিবিরোধ নির্বিকার নিরাপদ নিজীব ভাবে কল্পনা করে নিয়ে বলছি, আমরা সেই সভ্য জাতি, আমরা সেই আধ্যাত্মিক আৰ্য ; আমরা কেবল জপতপ করব, দলাদলি করব ; সমুদ্রযাত্রা নিষেধ করে, ভিন্ন জাতিকে অস্পৃশ্যশ্রেণীভুক্ত করে, আমরা সেই মহৎ প্রাচীন হিন্দুনামের সার্থকতা সাধন করব। - কিন্তু তার চেয়ে যদি সত্যকে ভালোবাসি, বিশ্বাস অনুসারে কাজ করি, ঘরের ছেলেদের রাশীকৃত মিথ্যার মধ্যে গোলগাল গলগ্রহের মতো না করে তুলে সত্যের শিক্ষায় সরল সবল দৃঢ় করে